সংজ্ঞা, প্রকৃতি, বিষয়বস্তু এবং সামাজিক সক্রিয়তা হিসাবে রাজনীতি PDF: প্রতিবছর বিভিন্ন সরকারি চাকরির পরীক্ষায় Evolution of Political Science | একাদশ শ্রেণী রাষ্ট্রবিজ্ঞান PDF থেকে অনেক প্রশ্ন আসে। তাই আমরা আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছি সংজ্ঞা, প্রকৃতি, বিষয়বস্তু এবং সামাজিক সক্রিয়তা হিসাবে রাজনীতি PDF.
নিচে সংজ্ঞা, প্রকৃতি, বিষয়বস্তু এবং সামাজিক সক্রিয়তা হিসাবে রাজনীতি PDF টি যত্নসহকারে পড়ুন ও জ্ঞানভাণ্ডার বৃদ্ধি করুন। সংজ্ঞা, প্রকৃতি, বিষয়বস্তু এবং সামাজিক সক্রিয়তা হিসাবে রাজনীতি PDF টি সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ডাউনলোড করতে এই পোস্টটির নীচে যান এবং ডাউনলোড করুন।
সংজ্ঞা, প্রকৃতি, বিষয়বস্তু এবং সামাজিক সক্রিয়তা হিসাবে রাজনীতি - Evolution of Political Science | একাদশ শ্রেণী রাষ্ট্রবিজ্ঞান
সংজ্ঞা, প্রকৃতি, বিষয়বস্তু এবং সামাজিক সক্রিয়তা হিসাবে রাজনীতি PDF
Dear Students, Gksolves.com চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতির সেরা ঠিকানা, আজ আমরা আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছি সংজ্ঞা, প্রকৃতি, বিষয়বস্তু এবং সামাজিক সক্রিয়তা হিসাবে রাজনীতি PDF. প্রতিবছর বিভিন্ন সরকারি চাকরির যেমন Railway Group D | PSC Clerkship | WBCS | SSC CHSL | SSC CGL | SSC MTS | WBP Abgari Constable | WBP SI | WBP Constable | ICDS Supervisor | Railway Group D | RRB NTPC | PSC Miscellaneous | TET | Upper Primary | Group D ইত্যাদি পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ হয়ে থাকে। এই সমস্ত চাকরির পরীক্ষা ছাড়াও মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক সম্বন্ধে আপনার সাধারণ ধারণা থাকা দরকার, তাই আমরা আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছি সংজ্ঞা, প্রকৃতি, বিষয়বস্তু এবং সামাজিক সক্রিয়তা হিসাবে রাজনীতি PDF যা আপনাদের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র সম্পর্কে ধারণা গঠন করতে বিশেষ সাহায্য করবে।
Google News এ আমাদের ফলো করুন
সংজ্ঞা, প্রকৃতি, বিষয়বস্তু এবং সামাজিক সক্রিয়তা হিসাবে রাজনীতি - Evolution of Political Science | একাদশ শ্রেণী রাষ্ট্রবিজ্ঞান
রাষ্ট্রবিজ্ঞান সংজ্ঞা, প্রকৃতি, বিষয়বস্তু এবং সামাজিক সক্রিয়তা হিসাবে রাজনীতি - Evolution of Political Science
অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর
১। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক কাকে বলা হয়?
উত্তর : অ্যারিস্টটলকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক বলা হয়।
২। কত খ্রিস্টাব্দে রাষ্ট্রবিজ্ঞান শব্দটির প্রথম প্রয়ােগ ঘটে ?
উত্তর : ১৭০১ খ্রিস্টাব্দে রাষ্ট্রবিজ্ঞান শব্দটির প্রথম প্রয়ােগ ঘটে।
৩। রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে কোন্ শাস্ত্রের সঙ্গে তুলনা করা যায় ?
উত্তর : রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে ‘আবহবিদ্যার সঙ্গে তুলনা করা যায়।
৪। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক কাকে বলা হয়?
উত্তর : মেকিয়াভেলিকে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক বলা হয়।
৫। রিপাবলিক’ গ্রন্থের রচয়িতা কে?
উত্তর : ‘রিপাবলিক’গ্রন্থের রচয়িতা হলেন প্লেটো।
৬। রাষ্ট্রবিজ্ঞান কীরূপ বিজ্ঞান ?
উত্তর : রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল অন্যতম সামাজিক বিজ্ঞান।
৭। রাষ্ট্রবিজ্ঞান কি মূল্যমান-নিরপেক্ষ?
উত্তর: রাষ্ট্রবিজ্ঞান মূল্যমান-নিরপেক্ষ নয়।
৮। কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান বলেছেন?
উত্তর: বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান বলেছেন।
৯। “ওয়েলথ অব নেশনস্” গ্রন্থটির রচয়িতা কে ?
উত্তর: “ওয়েলথ অব নেশনস্” গ্রন্থটির রচয়িতা হলেন অ্যাডাম স্মিথ।
১০। “মানুষ রাজনৈতিক জীব”—একথা কে বলেছেন?
উত্তর: “মানুষ রাজনৈতিক জীব”—একথা বলেছেন বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল।
১১। “রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শুরু ও শেষ রাষ্ট্রকে নিয়ে” -কে বলেছেন?
উত্তর: “রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শুরু ও শেষ রাষ্ট্রকে নিয়ে বলেছেন অধ্যাপক গার্নার।
১২। অর্থশাস্ত্র’ গ্রন্থটির রচয়িতা কে ?
উত্তর: ‘অর্থশাস্ত্র’ গ্রন্থটির রচয়িতা হলেন কৌটিল্য।
১৩। রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও নীতিশাস্ত্রকে সর্বপ্রথম কে স্বতন্ত্র শাস্ত্র বলে চিহ্নিত করেন?
উত্তর: রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও নীতিশাস্ত্রকে সর্বপ্রথম স্বতন্ত্র শাস্ত্র বলে চিহ্নিত করেন মেকিয়াভেলি।
১৪। “রাষ্ট্রবিজ্ঞান ব্যতীত ইতিহাস আলােচনা নিষ্ফল এবং ইতিহাস ব্যতীত রাষ্ট্রবিজ্ঞান ভিত্তিহীন”—কে বলেছেন?
উত্তর: অধ্যাপক জন সিলি বলেছেন, “রাষ্ট্রবিজ্ঞান ব্যতীত ইতিহাস আলােচনা নিষ্ফল এবং ইতিহাস ব্যতীত রাষ্ট্রবিজ্ঞান ভিত্তিহীন।
১৫। “যখন আমি কোনাে পরীক্ষায় এমন প্রশ্নপত্র দেখি যার শিরােনাম রাষ্ট্রবিজ্ঞান, তখন আমার দুঃখ হয় শিরােনামটির জন্য, প্রশ্নগুলির জন্য নয়”-কে বলেছেন?
উত্তর: অধ্যাপক মেটল্যা বলেছেন, “যখন আমি কোনাে পরীক্ষায় এমন প্রশ্নপত্র দেখি যার শিরােনাম রাষ্ট্রবিজ্ঞান, তখন আমার দুঃখ হয় শিরােনামটির জন্য, প্রশ্নগুলির জন্য নয়।”
১৬। “পজিটিভ ফিলজফি” গ্রন্থটির রচয়িতা কে ?
উত্তর: “পজিটিভ ফিলজফি” গ্রন্থটির রচয়িতা হলেন অধ্যাপক কোঁৎ (Comte)।
১৭। কে সর্বপ্রথম অর্থশাস্ত্রকে পৃথক শাস্ত্রের মর্যাদা দেন ?
উত্তর: অ্যাডাম স্মিথ সর্বপ্রথম অর্থশাস্ত্রকে পৃথক শাস্ত্রের মর্যাদা দেন।
১৮। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ব্যাবহারিক দিক কোনটি ?
উত্তর: রাজনীতি হল রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ব্যাবহারিক দিক।
১৯। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তত্ত্বগত দিক কোনটি ?
উত্তর: রাষ্ট্রদর্শন হল রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তত্ত্বগত দিক।
২০। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সঙ্গে ইতিহাসের কীরূপ সম্পর্ক ?
উত্তর: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সঙ্গে ইতিহাসের গভীর সম্পর্ক।
২১। রাজনীতির তত্ত্বগত আলােচনা শুরু হয় কত বছর আগে ?
উত্তর: রাজনীতির তত্ত্বগত আলােচনা শুরু হয় আড়াই হাজার বছর আগে।
২২। “Modern Political Analysis” গ্রন্থটির রচয়িতা কে?
উত্তর: “Modern Political Analysis গ্রন্থটির রচয়িতা হলেন রবার্ট ডাল।
২৩। কারা রাষ্ট্রকে এক শাশ্বত প্রতিষ্ঠান হিসাবে গণ্য করেন?
উত্তর: উদারনীতিবাদী দার্শনিকরা রাষ্ট্রকে এক শাশ্বত প্রতিষ্ঠান হিসাবে গণ্য করেন।
২৪। রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল একটি প্রগতিশীল বিজ্ঞান’-বলেছেন কে ?
উত্তর: ‘রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল একটি প্রগতিশীল বিজ্ঞান’– বলেছেন অধ্যাপক লর্ড ব্রাইস।
২৫। অ্যারিস্টটল কোথাকার দার্শনিক ?
উত্তর: অ্যারিস্টটল গ্রিক দার্শনিক।
২৬। রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হল, মানুষের জীবনকে সুন্দর ও মঙ্গলময় করে তােলা’- বলেছেন কে ?
উত্তর: রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হল, মানুষের জীবনকে। সুন্দর ও মঙ্গলময় করে তােলা’– বলেছেন বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল।
২৭। রাষ্ট্রকেন্দ্রিক রাজনীতির প্রথম প্রবক্তা কে ?
উত্তর: রাষ্ট্রকেন্দ্রিক রাজনীতির প্রথম প্রবক্তা হলেন গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টল।
২৮। “রাষ্ট্রবিজ্ঞানীকে সমাজবিজ্ঞানী এবং সমাজবিজ্ঞানীকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হতে হবে”-কে বলেছেন ?
উত্তর: “রাষ্ট্রবিজ্ঞানীকে সমাজবিজ্ঞানী এবং সমাজবিজ্ঞানীকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হতে হবে”- বলেছেন অধ্যাপক গার্নার।
২৯। “ইতিহাস রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গভীরতা জোগান দেয়”-কে বলেছেন?
উত্তর: ইতিহাস রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গতা জোগান দেয়”-বলেছেন উইলােবি।
৩০। দ্য পলিটিক্যাল ম্যান’ গ্রন্থটির রচয়িতা কে?
উত্তর: ‘দ্য পলিটিক্যাল ম্যান’ গ্রন্থটির রচয়িতা হলেন লিপস্টে।
৩১। “ইতিহাস হল অতীত রাজনীতি এবং রাজনীতি হল বর্তমান ইতিহাস”-কে বলেছেন?
উত্তর : ইতিহাস হল অতীত রাজনীতি এবং রাজনীতি হল বর্তমান ইতিহাস” বলেছেন ফ্রিম্যান।
৩২। রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে “মূল্যের কর্তৃত্বসম্পন্ন বরাদ্দের পাঠ”বলেছেন কে ?
উত্তর: ডেভিড ইস্টন “রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে ‘মূল্যের কর্তৃত্বসম্পন্ন বরাদ্দের পাঠ” বলেছেন।
৩৩। রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে ‘শ্রেণি সম্পর্কের বিজ্ঞান’ বলেছেন কে?
উত্তর: ভি. আই. লেনিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে ‘শ্রেণি সম্পর্কের বিজ্ঞান বলেছেন।
৩৪। দুজন আচরণবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর নাম লেখাে।
উত্তর: দুজন আচরণবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর নাম হল আর্থার বেন্টলি এবং গ্রাহাম ওয়ালাস।
৩৫। ‘পলিটিকস’ গ্রন্থের রচয়িতা কে?
উত্তর: ‘পলিটিকস’ গ্রন্থের রচয়িতা হলেন বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল।
৩৬। সঠিক নামকরণের সমস্যা নিয়ে অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানের তুলনায় রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধিক বিব্রত’-কে বলেছেন?
উত্তর: সঠিক নামকরণের সমস্যা নিয়ে অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানের তুলনায় রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধিক বিব্রত’ বলেছেন জেলিনেক (Jellinek)
৩৭। উদারনীতিবাদের জনক কাকে বলা হয়?
উত্তর: অধ্যাপক জন লক হলেন উদারনীতিবাদের জনক।
৩৮। ইংরেজি পলিটিকস’ শব্দটি কোন্ শব্দ থেকে এসেছে?
উত্তর: ইংরেজি ‘পলিটিকস’ শব্দটি গ্রিক শব্দ ‘পােলিস’ (Polis) থেকে এসেছে।
৩৯। “Modern Politics and Govern-ment” গ্রন্থটির রচয়িতা কে?
উত্তর: “Modern Politics and Govern-ment’ গ্রন্থটি রচনা করেন অ্যালান বল (Alan Ball)।
৪০। কত খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম রাষ্ট্রবিজ্ঞান কথাটি আধুনিক অর্থে ব্যবহৃত হয়?
উত্তর: ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থতালিকা’-তে সর্বপ্রথম রাষ্ট্রবিজ্ঞান’ কথাটি আধুনিক অর্থে ব্যবহার করা হয়।
৪১। কত খ্রিস্টাব্দে রাশিয়াতে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হয়েছিল ?
উত্তর: ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়াতে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হয়েছিল।
সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর
প্রশ্ন: রাজনীতির সাবেকি সংজ্ঞাটি কী?
উত্তর: রাজনীতির সাবেকি সংজ্ঞাটি হল কোনাে রাষ্ট্রের কর্মকাণ্ডের সেই অংশে যা প্রধানত সরকারের মধ্য দিয়ে চলে এবং সরকারের সেই ধরন বা অংশ যা আইনের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
প্রশ্ন: রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে কেন একটি ‘প্রগতিশীল বিজ্ঞান’ বলা হয় ?
উত্তর: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু ও আলােচনা ক্ষেত্র ছােটো গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ নয়। সমাজে রাষ্ট্রে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এই সমস্যা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচনায় স্থান পাচ্ছে তার ফলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচনার পরিধি ধীরে ধীরে প্রসারিত হচ্ছে। তাই বলা হয় বিজ্ঞান কে ‘প্রগতিশীল বিজ্ঞান’ (Progressive Science)।
প্রশ্ন: রাষ্ট্রবিজ্ঞানে কি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করা সম্ভব?
উত্তর: রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করা সম্ভব নয়। কারণ, মানুষ এবং মনুয়া দই হল রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু। প্রকৃতি বিজ্ঞানীর মতাে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী নিজের প্রয়ােজনে গবেষণা ক্ষেত্রে প্রয়ােজনীয় পরিবেশ সৃষ্টি করে নিতে পারেন না। তাদের নির্ভর করতে হয় বাহ্যিক পরিবেশের ওপর। এই বাহ্যিক পরিবেশ পরিবর্তনশীল বলেই তা রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর আয়ত্তের বাইরে। তাই বহু ক্ষেত্রে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীকে অনুমানের ওপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। ফলে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনেক সময় তর্কের বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়ায়। তা ছাড়া, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর পক্ষে পরীক্ষামূলক পদ্ধতি অনুসরণ করা সম্ভব নয়। আর সম্ভব হলেও তা বিপজ্জনক।
প্রশ্ন: ‘ওয়েলথ অব নেশনস’ গ্রন্থটি কার লেখা এবং তিনি কোথাকার নাগরিক ছিলেন?
উত্তর: প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ ‘ওয়েলথ অব নেশনস’ গ্রন্থটি রচনা করেছেন। তিনি ছিলেন ইংল্যান্ডের নাগরিক।
প্রশ্ন: রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মূল্যমান নিরপেক্ষ আলােচনা সম্ভব কি?
উত্তর: একজন বিজ্ঞানী নিরপেক্ষভাবে পরীক্ষানিরীক্ষা চালান। কিন্তু একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী কখনই নিরপেক্ষভাবে পরীক্ষানিরীক্ষা চালাতে পারেন না। কারণ, নিজের আর্থ-সামাজিক অবস্থান তাঁর চিন্তাভাবনাকে যথেষ্ট পরিমাণে প্রভাবিত করে। তাই তাঁর পক্ষে শ্রেণি-নিরপেক্ষভাবে কোনাে রাজনৈতিক পর্যালােচনা চালানাে সম্ভব হয় না। ফলে কোটি উচিত কোটি অনুচিত, কোটি ভালাে, কোটি মন্দ সে সম্পর্কে তিনি মতামত জ্ঞাপন করেন। তাই বলা যায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মূল্যমান-নিরপেক্ষ আলােচনা সম্ভব নয়।
প্রশ্ন: আচরণবাদ’ বলতে কী বােঝায়?
উত্তর: ‘আচরণবাদ’ হল এমন এক আন্দোলন যা তত্ত্ব, পদ্ধতি, গবেষণা ও অনুসন্ধানকে নিখুঁত করার জন্য মনােবিজ্ঞান, সমাজতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব ও অর্থনীতির সঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সম্পর্ক গড়ে তােলে।
প্রশ্ন: লেনিন রাজনীতিকে অর্থনীতির ঘনীভূত রূপ’ বলেছেন কেন?
উত্তর: কোনাে দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা সেখানকার অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। কারণ, সমাজের অর্থনৈতিক দিক থেকে প্রভুত্বকারী শ্রেণির স্বার্থরক্ষার প্রয়ােজনেই রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ প্রতিষ্ঠিত হয়। মার্কসবাদীরা রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থবিদ্যাকে সম্পূর্ণ দুটি পৃথক শাস্ত্র হিসাবে আলােচনা করা অপেক্ষা তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে আলােচনাকেই সংগত বলে মনে করেন। তাই লেনিন রাজনীতিকে অর্থনীতির ঘনীভূত রূপ’ বলে বর্ণনা করেছেন।
প্রশ্ন: অ্যারিস্টটল মানুষকে সমাজবদ্ধ জীব বলেছেন কেন?
উত্তর: মানুষ তার সমাজের মধ্যেই জন্মায়, বড়াে হয় এবং মৃত্যুবরণ করে। সমাজ-নিরপেক্ষ মানুষের ব্যক্তি হিসাবে কোনাে স্বতন্ত্র পরিচয় থাকতে পারে না। সমাজ-বহির্ভূত মানুষের নিঃসঙ্গ জীবন কল্পলােকের বিষয়মাত্র। তাই বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল বলেছেন মানুষ সমাজবদ্ধ জীব।
প্রশ্ন: মূল্যের শ্রমতত্ত্ব (Labour Theory of Value) প্রচার করেছিলেন এমন দুজন অর্থনীতিবিদের নাম লেখাে।
উত্তর: মূল্যের শ্রমতত্ত্ব (Labour Theory of Value) প্রচার করেছিলেন এমন দুজন অর্থনীতিবিদের নাম হল অ্যাডাম স্মিথ এবং রিকার্ডো।
প্রশ্ন: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক’ কাকে বলা হয়? তাঁর রচিত বিখ্যাত গ্রন্থটির নাম কী ?
উত্তর: গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলকে ‘রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক’ বলা হয়। তাঁর রচিত বিখ্যাত গ্রন্থটির নাম হল ‘পলিটিকস (Politics)।
প্রশ্ন: রাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান সম্ভব কি ?
উত্তর: বর্তমানে রাষ্ট্র জনকল্যাণসাধনের উদ্দেশ্যে নানারকম ইতিবাচক কর্মসূচি গ্রহণ করে থাকে। এইসব কর্মসূচির বেশির ভাগ অংশই অথবিদ্যার আলােচ্য বিষয়। যেমন—শ্রমিক কল্যাণ, গ্রামােন্নয়ন, নগরােন্নয়ন, বেকার সমস্যা প্রভৃতি। এইসব কর্মসূচি গ্রহণ ও রূপায়ণের দায়িত্ব পালন করে সরকার তথা রাষ্ট্র। তাই রাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে কোনােরকম অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের কথা কল্পনা করা যায় না।
প্রশ্ন: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি আধুনিক সংজ্ঞা দাও।
উত্তর: রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল এমন একটি সমাজবিজ্ঞান যেখানে রাষ্ট্র ও রাজনীতির দার্শনিক, সাংগঠনিক, প্রশাসনিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইন ও সাংগঠনিক সম্পর্কের প্রসঙ্গ এবং বহুবিধ রাজনৈতিক ব্যবস্থার তুলনামূলক প্রসঙ্গের বিজ্ঞানসম্মত আলােচনা ও পর্যালােচনা চলে।
প্রশ্ন: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু বিশ্লেষণে মনােবিজ্ঞানের ভূমিকা কী?
উত্তর: বর্তমানে রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস, রাজনৈতিক কার্যকলাপের উদ্দেশ্য ও গতিপ্রকৃতি, চাপ সৃষ্টিকারী গােষ্ঠীর ক্রিয়াকলাপ, ভােটদাতাদের নির্বাচনী আচরণ প্রভৃতি রাষ্ট্র বিজ্ঞানের বিষয়বস্তুর অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু মনােবিজ্ঞানের সাহায্য ছাড়া রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর পক্ষে এগুলি সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যথেষ্ট কষ্টকর। এছাড়া, বর্তমানে সৈন্যবাহিনী গঠন, সরকারি কর্মচারী নিয়ােগ, বিচারপতিগণ কর্তৃক বিচারকার্য সম্পাদন, অপরাধের কারণ অন্বেষণ প্রভৃতি ক্ষেত্রেও সরকারকে মনস্তত্ত্বের সাহায্য গ্রহণ করতে হয়। তাই বলা যায় মনােবিজ্ঞানের মধ্যেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিকড় নিহিত রয়েছে।
প্রশ্ন: রাষ্ট্রবিজ্ঞান’ শব্দটির প্রথম প্রয়ােগ করেন কে এবং কত খ্রিস্টাব্দে করেছিলেন ?
উত্তর: রাষ্ট্রবিজ্ঞান’ শব্দটি প্রথম প্রয়ােগ করেন লিবনিজ (Leibniz), ১৭০১ খ্রিস্টাব্দে।
প্রশ্ন: রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানে মনােবিজ্ঞানের কোনাে ভূমিকা আছে কী?
উত্তর : বর্তমানে দেশের মধ্যে এমন কিছু সমস্যা আছে, যার রাজনৈতিক পথে সুষ্ঠু সমাধান সম্ভব নয়। মনােবিজ্ঞানের সূত্র ধরেই এইসব সমস্যার সমাধান করা যায়। যেমন সাম্প্রদায়িক সমস্যা। আবার, কোনাে কোনাে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান সূত্র মনােবিজ্ঞানে খুঁজে পাওয়া যায়। পাঞ্জাবে খালিস্তানী, পশ্চিমবঙ্গে গাের্খাল্যাণ্ড আন্দোলন প্রভৃতি প্রকৃতিগতভাবে রাজনৈতিক সমস্যা হিসাবে জাতীয় ঐক্য ও সংহতির প্রতি চ্যালেঞ্জ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করলেও এইসব সমস্যার প্রকৃত কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে বিভিন্ন জনগােষ্ঠীর মনস্তত্ত্বের মধ্যে।
প্রশ্ন: সিজউইক, জেলিনেক প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তুকে কটি ভাগে ভাগ করেছেন এবং কী কী?
উত্তর সিজউইক, জেলিনেক প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তুকে দুটি ভাগে ভাগ করেছে। এই দুটি ভাগ হল- (ক) তত্ত্বগত রাজনীতি এবং (খ) ফলিত বা ব্যাবহারিক রাজনীতি।
প্রশ্ন: রাজনীতিকে নীতিশাস্ত্র থেকে প্রথম কখন এবং কে মুক্ত করেছিলেন?
উত্তর: ষােড়শ শতাব্দীর প্রথম দিকে প্রখ্যাত ইটালীয় চিন্তাবিদ মেকিয়াভেলি রাজনীতিকে নীতিশাস্ত্র থেকে প্রথম মুক্ত করেছিলেন।
প্রশ্ন: আধুনিক অর্থে কখন, কোথায় রাষ্ট্রবিজ্ঞান শব্দটির ব্যবহার হয় ?
উত্তর: লিপসেট তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘The Political Man’-এ শব্দটি উল্লেখ করেছেন। ১৮৯০ খ্রিস্টব্দে আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থ তালিকায় রাষ্ট্রবিজ্ঞান’ শব্দটি আধুনিক অর্থে সর্বপ্রথম ব্যবহৃত হয়।
প্রশ্ন: নীতিহীন রাজনীতি সমাজে বিশৃঙ্খলার জন্ম দেয় কি ?
উত্তর: ন্যায়নীতিবােধ সম্পূর্ণ বিসর্জন দিয়ে কোনাে রাষ্ট্রনেতা রাজনৈতিক কার্যাদি সম্পাদন করতে সক্ষম হন না। কারণ, নৈতিকতার বন্ধনে আবদ্ধ না থাকলে শাসক ও শাসিতের মধ্যে কখনই সুসম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে না। তাই বলা যায় পাশবিক বা আসুরিক বল নয়, জনগণের সম্মতিই হল রাষ্ট্রের ভিত্তি। আবার লর্ড অ্যাক্টন বলেন—সরকার কী নির্দেশ দেবে সেটা বড়াে কথা নয়, তার কী নির্দেশ দেওয়া উচিত সেটাই হল বড়াে কথা। তাই বলা যায়-নীতিহীন রাজনীতি সুন্দর ও আদর্শ সমাজের পরিবর্তে বিশৃঙ্খল সমাজের জন্ম দেয়।
প্রশ্ন: আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্মেলন (1948)-এ গৃহীত প্রস্তাবে যেসব বিষয়কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচনা ক্ষেত্রের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল সেগুলি উল্লেখ করাে।
উত্তর: আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্মেলন (1948)-এ গৃহীত প্রস্তাবে যেসব বিষয়কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচনা ক্ষেত্রের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল সেগুলি হল—(ক) রাজনৈতিক তত্ত্ব ও তার ইতিহাস, (খ) রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ, (গ) রাজনৈতিক মতবাদ ও দল এবং (ঘ) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক।
প্রশ্ন: রাষ্ট্রীয় আইনের মধ্যে সামাজিক ন্যায়নীতিবােধের প্রতিফলন ঘটে বলে কী তুমি মনে করাে?
উত্তর: যে আইনের সাহায্যে সরকার তথা রাষ্ট্র মানুষের বাহ্যিক আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে, সেই আইনের মধ্যে সামাজিক ন্যায়নীতিবােধের একান্ত অভাব থাকে, সেই দেশের আইন কখনই উচ্চ মানসম্পন্ন হতে পারে না। বস্তৃত সমাজে সুদীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত নৈতিক বিধিগুলি কালক্রমে আইনে রূপান্তরিত হয়। তাই বলা যায়, কেবল রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত, ঘােষিত ও প্রযুক্ত হলেই আইনকে আদর্শ আইন বলা যায় না। আইনের মধ্যে বৈধতা এবং নৈতিক মূল্যবােধ’ অবশ্যই থাকা প্রয়ােজন।
প্রশ্ন: সমাজবিজ্ঞান গবেষণা পর্ষদ কত খ্রিস্টাব্দে এবং কোথায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল?
উত্তর: সমাজবিজ্ঞান গবেষণা পর্ষদ’ ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে (Social Science Research Council) প্রতিষ্ঠিত হয়।
প্রশ্ন: রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে কারা বিজ্ঞান হিসাবে অভিহিত করেছেন?
উত্তর: অ্যারিস্টটল, বদিন, বুন্টসলি, মন্তেস্কু, পােলন, লর্ড ব্রাইস প্রমুখরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে বিজ্ঞান হিসাবে অভিহিত করেছেন।
প্রশ্ন: “ইতিহাস রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গভীরতা জোগান দেয়।” উইলােবি এই উক্তিটি কেন করেছিলেন?
উত্তর: ইতিহাস প্রদত্ত তথ্যাদির উপর ভিত্তি করে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বর্তমান সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার ত্রুটিবিচ্যুতিগুলি অতি সহজেই নির্ধারণ করতে সক্ষম হন। ফলে, তুলনামূলক আলােচনার সাহায্যে আদর্শ রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কে মতামত জ্ঞাপন করা তাদের পক্ষে সহজসাধ্য হয়। ওইসব ঐতিহাসিক তথ্য যত বেশি পরিমাণে সংগৃহীত হবে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচনাও তত বেশি গভীরতা লাভ করবে। তাই উইলােবি বলেছেন, “ইতিহাস রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গভীরতা জোগান দেয়।”
প্রশ্ন: অধ্যাপক গার্নার প্রদত্ত রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞাটি লেখো।
উত্তর: অধ্যাপক গার্নারের মতে, “রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলােচনার শুরু ও সমাপ্তি রাষ্ট্রকে নিয়ে।”
প্রশ্ন: রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্পর্কে ল্যাস্কির অভিমত কী?
উত্তর : অধ্যাপক ল্যাস্কির মতে–সংগঠিত রাষ্ট্রের পরিপ্রেক্ষিতে মানবজীবনের আলােচনাই রাষ্ট্রবিজ্ঞান। মানবজীবনকে প্রভাবিত করে এমন কোনাে কিছুকেই আমরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচনা থেকে বাদ দিতে পারি না।
প্রশ্ন: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের রাষ্ট্রকেন্দ্রিক আলােচনার দুজন সমালােচকের নাম লেখাে।
উত্তর: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের রাষ্ট্রকেন্দ্রিক আলােচনার দুজন সমালােচকের নাম হল—(i) ম্যাকেঞ্জি (Mackenzie) এবং (ii) ডেভিড ইস্টন।
প্রশ্ন: রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে বিজ্ঞান বলার বিপক্ষে কারা মত প্রকাশ করেছেন?
উত্তর: কোঁৎ, বাকল, মেটল্যান্ড, গিলকাইস্ট প্রমুখ রাষ্ট্রদার্শনিকরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে বিজ্ঞান বলার বিপক্ষে অভিমত দিয়েছেন।
প্রশ্ন: ডেভিড ইস্টন রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে কেন ‘মূল্যের কর্তৃত্বসম্পন্ন বরাদ্দের পাঠ’ বলেছেন?
উত্তর: রাষ্ট্রবিজ্ঞান ক্ষমতার বণ্টন ও প্রয়ােগের দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়। কোনাে মূল্যবান বস্তুর বণ্টন নিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তি বা গােষ্ঠীর মধ্যে বিরােধ বাধলে প্রচলিত প্রথার ভিত্তিতে যখন সেইসব বিরােধের মীমাংসা করা সম্ভব হয় না, তখন সামাজিক কর্তৃত্বের সাহায্যে একটি নীতি প্রণয়ন করা। হয়। তাই ডেভিড ‘ইস্টন রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে ‘মূল্যের কর্তৃত্বসম্পন্ন বরাদ্দের পাঠ’ বলেছেন।
প্রশ্ন: অর্থনীতির জনক কে? তাঁর রচিত গ্রন্থটির নাম কী?
উত্তর: ইংরেজ দার্শনিক অ্যাডাম স্মিথকে অর্থনীতির জনক বলা হয়। ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁর রচিত fatto selfs al ‘An Inquiry into the Nature and Causes of the Wealth of Nations’ সংক্ষেপে Wealth of Nations. .
প্রশ্ন: কয়েকজন আচরণবাদী রাষ্ট্রদার্শনিকের নাম লেখাে।
উত্তর: ল্যাসওয়েল, কেপলান, রবার্ট ডাল, ডেভিড ইস্টন, চার্লস মেরিয়াম প্রমুখরা হলেন আচরণবাদী রাষ্ট্রদার্শনিকদের মধ্যে অন্যতম।
বর্ণনামূলক প্রশ্নোত্তর
প্রশ্ন: রাষ্ট্রবিজ্ঞান কাকে বলে ?
উত্তর: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা ও ধারণা তার আলােচনা ক্ষেত্রের পরিধির দ্বারাই নির্ধারিত হয়। অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানের ন্যায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানও হল গতিশীল বিজ্ঞান। মানুষের সমাজ ও সভ্যতার ক্রম বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচনার পরিধিও পরিমার্জিত এবং পরিবর্তিত হয়েছে। তার ফলে রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্বন্ধে ধারণারও বিবর্তন ঘটেছে। এই কারণে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিভিন্ন সংজ্ঞার সৃষ্টি হয়েছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা দেওয়া সহজ নয়। কারণ, ওয়াসবি (Washby) বলেছেন- রাষ্ট্রবিজ্ঞান। সম্পর্কে এত বেশি মতপার্থক্য আছে এবং এই বিষয়টি এতই পরিবর্তনশীল যে, এর একটি নির্দিষ্ট সংজ্ঞা দেওয়া সম্ভব নয়।
সাধারণ অর্থে বিজ্ঞান বলতে বােঝায়, বিশেষ জ্ঞান। সুতরাং যে শাস্ত্র পাঠ করলে রাষ্ট্র সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান পাওয়া যায়, তাকে বলা হয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান। অর্থাৎ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচনার মূল বিষয়বস্তু হল রাষ্ট্র। রাষ্ট্র সম্পর্কে আলােচনা বলতে বােঝায়—রাষ্ট্রের উৎপত্তি, গতি এবং প্রকৃতি বিষয়ে আলােচনা। সেদিক থেকে বলা যায়, যে শাস্ত্রের মূল বিষয়বস্তু হল রাষ্ট্র- তারই নাম রাষ্ট্রবিজ্ঞান। অধ্যাপক গার্নারের (Garner) ভাষায়, “Political Science begins and ends toith the State,” অর্থাৎ রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্রকে নিয়ে আলােচনা শুরু এবং শেষ করে।
কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞান শুধু রাষ্ট্রকে নিয়ে আলােচনা করে না, সরকার নিয়েও আলােচনা করে। কারণ, রাষ্ট্রের ইচ্ছা সরকারের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়। তাই গিলক্রাইস্ট (Gilchrist) বলেছেন, “Political Science deals with the State and Government,” অর্থাৎ যে শাস্ত্র রাষ্ট্র ও সরকার নিয়ে আলােচনা করে তাকে বলে রাষ্ট্রবিজ্ঞান। অধ্যাপক গেটেল (Gettell) বলেছেন- বর্তমানে বিশ্ব রাজনীতিতে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তাই এই প্রতিষ্ঠানের আলােচনা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সেদিক থেকে বলা যায়, যে শাস্ত্র রাষ্ট্র, সরকার এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান নিয়ে আলােচনা করে, তাকে বলা হয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান।
কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ এইসব সংজ্ঞা অসম্পূর্ণ বলে মনে করেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলেন, অ্যালান বল (Alan Ball), ডেভিড ইস্টন (David Eastan) প্রমুখ। এদের বক্তব্য হল- রাষ্ট্রবিজ্ঞান শুধুমাত্র রাষ্ট্র ও সরকার নিয়ে আলােচনা করে না। সমাজের মধ্যে নানারকম বিরােধ ও সংঘাত আছে। তার মীমাংসার চেষ্টাকে বলে রাজনৈতিক কার্যকলাপ। আবার রাজনৈতিক কার্যকলাপ ও ক্ষমতা এবং ব্যক্তিগত ও গােষ্ঠীগত রাজনৈতিক আচার আচরণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু। সুতরাং বলা যায় যে শাস্ত্র রাষ্ট্র, সরকার, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক কার্যকলাপ, ক্ষমতা, ব্যক্তিগত ও গােষ্ঠীগত আচার-আচরণ প্রভৃতি আলােচনা করে, তাকে বলা হয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান।
প্রশ্ন: রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠের কোনাে প্রয়ােজনীয়তা আছে কি?
উত্তর: রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠ করে সমাজ বিকাশের রাজনৈতিক ধারার অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে তথা গণতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র, ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রতিবন্ধকতা, দারিদ্র্য, বেকারি, শােষণ, ঔপনিবেশিকতা, পরাধীনতা প্রভৃতি বিষয়ে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের অধিকারী। হওয়া সম্ভব হয়। বস্তুত রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠের বহু প্রয়ােজনীয়তা আছে। কারণ-
প্রথমত, মানুষ রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠ করে তার অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে। এই অধিকার ও কর্তব্য সচেতনতা ছাড়া ব্যক্তিসত্তার পূর্ণাঙ্গ বিকাশ সম্ভব নয়।
দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাজনৈতিক জ্ঞানবিকাশের মধ্য দিয়ে নাগরিককে সরকারের ভিত্তি, প্রকৃতি ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবহিত করে।
তৃতীয়ত, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তুলনামূলক আলােচনার মধ্য দিয়ে বিভিন্ন ধরনের সরকারের গুণাগুণ উপলদ্ধি করা সম্ভব।
চতুর্থত, রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠে আগ্রহী হওয়ার ফলে মানুষের চিন্তাশক্তির বিকাশ ঘটে। এর ফলে মানুষ বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা সমাধানের পথ নির্দেশ করতে পারে।
পঞ্চমত, রাষ্ট্রবিজ্ঞান মানুষকে জাতি-ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সমাজের সকলকে অভিন্নতার বন্ধনে ঐক্যবদ্ধ করে। সমাজের সকলকে ভালােবাসতে শেখায়।
ষষ্ঠত, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষা মানুষকে কুসংস্কারমুক্ত হতে সাহায্য করে।
সপ্তমত, মানুষের মধ্যে আন্তর্জাতিকতাবােধ, বিশ্ব-সৌভ্রাতৃত্ববােধ, সহনশীলতা, বিশ্বশান্তি প্রভৃতিকে জাগ্রত গ্রতে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
অষ্টমত, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বিভিন্ন মতাদর্শ নিয়ে আলােচনা হয়। আলােচনা ও পর্যালােচনার মধ্য দিয়ে মানুষ শ্রেয়তর রাজনৈতিক মতাদর্শের সন্ধান পায়।
নবমত, বর্তমান যুগে ভূগােলের সীমারেখা দূর হয়ে গেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের ঘটনাও আজ আমাদের জীবনে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। আজকের পৃথিবীতে কোনাে দেশ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে পারে না। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন সমস্যার গতিপ্রকৃতি উপলদ্ধি করাও বিশেষ প্রয়ােজন হয়ে পড়ে। সেদিক থেকেও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচনা ও জ্ঞান বিশেষ সহায়ক।
প্রশ্ন: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের রাষ্ট্রকেন্দ্রিক আলােচনার সীমাবদ্ধতাগুলি কী কী?
উত্তর: রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের রাষ্ট্রকেন্দ্রিক আলােচনার তীব্র বিরােধিতা করেছেন। কারণ, এরূপ আলােচনা সংকীর্ণতা দোষে দুষ্ট। ম্যাকেঞ্জি (Mackenzie) এরূপ আলোচনার ধারাকে অত্যধিক, আইনমুখী, কৃত্রিম এবং খামখেয়ালিপূর্ণ বলে বর্ণনা করেছেন। কারণ –
প্রথমত, বিশ্বের নতুন রাষ্ট্রগুলির প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, এদের বেশিরভাগই দেশের ভেতর থেকে গড়ে ওঠেনি। তাদের ওপর হয় জোর করে রাষ্ট্রব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, নয়তাে বা বাছাই করা হয়েছে। তা ছাড়া, এইসব দেশে রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনগুলির মধ্যেকার সম্পর্কও পশ্চিমি দেশগুলিতে বিদ্যমান সম্পর্কের অনুরূপ নয়। তাই কেবলমাত্র রাষ্ট্রকেন্দ্রিক আলােচনার মাধ্যমে সব রাষ্ট্রের প্রকৃতি ও কাঠামাে সম্পর্কে অভিন্ন ধারণা লাভ করা যায় না।
দ্বিতীয়ত, পশ্চিমি দেশগুলিতে রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে সম্পর্কের পরিবর্তন সাধিত হওয়ার ফলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পুরােনাে ধারণা পরিবর্তিত অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। সাবেকি রাষ্ট্রকেন্দ্রিক ধারণার সাহায্যে বর্তমানে রাষ্ট্রের সঙ্গে বিভিন্ন নাগরিক সংগঠনের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়।
তৃতীয়ত, সমাজবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার মধ্যে ক্রমবর্ধমান সহযােগিতা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচনাক্ষেত্র সম্পর্কিত রাষ্ট্রকেন্দ্রিক ধ্যানধারণার ওপর কঠিন আঘাত হেনেছে।
চতুর্থত, বর্তমানে বিভিন্ন সামাজিক গােষ্ঠীর আলােচনা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানের রাষ্ট্রকেন্দ্রিক আলােচনার পরিসমাপ্তি ঘটেছে। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলােচনার সময় সামাজিক মনস্তত্ত্ব, ব্যক্তিকেন্দ্রিক সমাজতত্ত্ব, সামাজিক ভাষাতত্ত্ব, সামাজিক নৃতত্ত্ব প্রভৃতির গবেষণা পদ্ধতি অনুসরণ করতে শুরু করেছেন। ফলে গতানুগতিকতার বন্ধন ছিন্ন করে রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমাজের বৃহত্তর আলােচনায় অংশগ্রহণ করতে সক্ষম হয়েছে। তাই ডেভিড ইস্টন বলেছেন—যেসব উপাদান কোনাে ঘটনাকে রাজনৈতিক উৎকর্ষ প্রদান করে, রাষ্ট্রকেন্দ্রিক আলােচনা সেগুলিকে বিশ্লেষণ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
প্রশ্ন: রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে বিজ্ঞান বলার পেছনে কী কী যুক্তি আছে?
উত্তর : রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে বিজ্ঞান না বলার পক্ষে যুক্তি দেখানাে হলেও অ্যারিস্টটল, পােলক প্রভৃতি রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে বিজ্ঞান বলেছেন। পােলক বলেছেন- “যারা রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে বিজ্ঞান বলতে অস্বীকার করেন, তাঁরা বিজ্ঞানের সংজ্ঞা জানেন না। প্রকৃতপক্ষে, রাষ্ট্রবিজ্ঞান একটি বিজ্ঞান। কারণ-
প্রথমত, সাধারণ বিজ্ঞানের মতাে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সাধারণত সূত্র বের করা সম্ভব। যেমন, অ্যারিস্টটল বলেছেন যে, সমাজের মধ্যে বৈষম্য থাকলে বিক্ষোভ দেখা দিতে পারে। এই সূত্র কেউ অস্বীকার করতে পারবে না।
দ্বিতীয়ত, সাধারণ বিজ্ঞানের মতাে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিষয়বস্তুর শ্রেণিবিভাগ, বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ করা যায়। যেমন, অ্যারিস্টটল ১৫৮টি নগর রাষ্ট্রের সংবিধান তুলনামূলক আলােচনা করে যে সূত্র প্রতিষ্ঠা করে গেছেন, তা অস্বীকার করা যাবে না। শুধু তাই নয়, ভবিষ্যতে অনুরূপ অবস্থায় বিনা দ্বিধায় সেগুলি প্রয়ােগ করা যায়।
তৃতীয়ত, লর্ড ব্রাইস বলেছেন—মানুষের রাজনৈতিক আচরণ জটিল হলেও তার মধ্যে বিশেষ সামঞ্জস্য দেখা যায়। এই সামঞ্জস্যপূর্ণ আচরণ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সাধারণ সূত্র বা নিয়ম নির্ধারণ করা যায়।
চতুর্থত, আধুনিককালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরীক্ষার ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়ােগ করা সম্ভব হচ্ছে; পরিসংখ্যান ও গাণিতিক তত্ত্ব প্রয়ােগ করে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। আচরণবাদীরা এই তত্ত্ব প্রয়ােগের পক্ষপাতী। চার্লস মেরিয়াম, ল্যাসওয়েল প্রভৃতি আচরণবাদীরা রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলােচনার ক্ষেত্রে এই পরিসংখ্যান পদ্ধতি গ্রহণ করেছেন। প্রণব রায় এই পদ্ধতি প্রয়ােগ করে ভারতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের ধারা প্রবাহিত করেছেন।
প্রশ্ন: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু সম্পর্কে মার্কসবাদীদের অভিমত কী?
উত্তর: মার্কসবাদীদের মতে, শ্রেণিবিভক্ত সমাজে রাষ্ট্রের সহায়তায় অর্থনৈতিক দিক থেকে প্রভূত্বকারী শ্রেণি নিজেদের শ্রেণি-শাসন ও শ্রেণি-শােষণকে অব্যাহত রাখার জন্য সচেষ্ট হয়, সেহেতু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাই হল, রাজনীতির সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ আলােচ্য বিষয়। কারণ, এইরকম সমাজে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার জন্য বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে শ্রেণিদ্বন্দ্ব বা শ্রেণিসংগ্রাম নিরন্তর চলতে থাকে। এই দ্বন্দ্বশীল সমাজে শ্রেণিগত স্বার্থরক্ষা ও উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য প্রতিটি শ্রেণি যেসব পদ্ধতি অবলম্বন করে তার প্রতিফলন রাজনীতির মধ্যে ঘটে। তাই লেনিন বলেছেন- বিভিন্ন শ্রেণির সঙ্গে রাষ্ট্র ও সরকারের সম্পর্ক এবং বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যেকার সম্পর্কই হল রাজনীতি। তবে, মার্কসবাদীদের মতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা রাজনীতির প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয় হলেও তা জাতিসমূহের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক এবং বিভিন্ন সামাজিক গােষ্ঠী ও রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যেকার সম্পর্ককে নিয়েও আলােচনা করে। তা ছাড়া, বিভিন্ন রাষ্ট্রের পারস্পরিক সম্পর্কও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তুর অন্তর্ভুক্ত বলে মার্কসবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ মনে করেন। সুতরাং বলা যায়, রাষ্ট্রীয় কার্যে অংশগ্রহণ, রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ, রাষ্ট্রীয় কার্যের বিভিন্ন রূপ, লক্ষ্য ও বিষয়বস্তু নির্ধারণকেই মার্কসবাদীরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়সূচির অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষপাতী। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে, সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠিত হলে যেহেতু সমাজের বুক থেকে রাষ্ট্র অপ্রয়ােজনীয় বলে নিজেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে, সেহেতু এরূপ সমাজে রাজনীতির প্রকৃতি ও বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই পরিবর্তন সূচিত হবে।
প্রশ্ন: রাষ্ট্রবিজ্ঞান কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে ইতিহাসের কাছে ঋণী?
উত্তর: রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাসের পারস্পরিক সম্পর্ক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, রাষ্ট্রবিজ্ঞান। ইতিহাসের ওপর যথেষ্ট পরিমাণে নির্ভরশীল। সে কারণেই তা ইতিহাসের কাছে ঋণী। রাষ্ট্রবিজ্ঞান কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে ইতিহাসের কাছে ঋণী তা নিম্নে উল্লেখ করা হল-
প্রথমত, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রকৃত উদ্দেশ্য হল আদর্শ সমাজ এবং আদর্শ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তাকে ইতিহাসের দ্বারস্থ হতে হয়। কারণ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ইতিহাস থেকে নানা তথ্য ও উপাদান সংগ্রহ করে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সূত্র গড়ে তােলে। যেমন—ইতিহাস থেকে একনায়কের কার্যাবলি বিশ্লেষণ করে একনায়কতন্ত্রের দোষ-গুণ নির্ধারণ করা হয়। তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞান ইতিহাসের কাছে ঋণী।
দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্র নিয়ে আলােচনা করে। কিন্তু রাষ্ট্র সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করতে গেলে রাষ্ট্র পূর্বে কেমন ছিল, কীভাবে বর্তমান অবস্থায় এসেছে, তা জানা প্রয়ােজন। এর জন্যে ইতিহাসের আশ্রয় নিতে হবে।
তৃতীয়ত, ইতিহাস প্রদত্ত তথ্যাদির ওপর ভিত্তি করে রাষ্টবিজ্ঞানীরা বর্তমান সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার ত্রুটিবিচ্যুতিগুলি অতি সহজেই নির্ধারণ করতে সক্ষম হন। ফলে তুলনামূলক আলোচনার সাহায্যে আদর্শ রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কে মতামত জ্ঞাপন করা তাদের পক্ষে সহজসাধ্য হয়। এইসব ঐতিহাসিক তথ্য যত বেশি পরিমাণে সংগৃহীত হবে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচনাও তত বেশি গভীরতা লাভ করবে। উইলােবির মতে, “ইতিহাস রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গভীরতা জোগান দেয়।”
চতুর্থত, ইতিহাসের ঘটনার পটভূমিতে অনেক সময় রাজনৈতিক মতবাদ গড়ে ওঠে। হবসের “লেভিয়াথান গ্রন্থ” ও “সামাজিক চুক্তি মতবাদ”ইংল্যান্ডে ঐতিহাসিক ঘটনার পটভূমিতে জন্ম নিয়েছিল।
পঞ্চমত, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জেলিনেক বলেছেন— রাষ্ট্রের মধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান থাকে। তাদের কাজের মূল্যায়ন করতে গেলে অতীতে তারা কী ধরনের কাজ করত তা জানা দরকার। ইতিহাস এগুলি আমাদের জানতে সাহায্য করে বলে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ইতিহাসের কাছে ঋণী।
প্রশ্ন: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সঙ্গে অর্থবিদ্যার কোন কোন ক্ষেত্রে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে ?
উত্তর: প্রাচীনকালে রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং অর্থনীতি পৃথক ছিল না। অ্যারিস্টটল অর্থবিদ্যাকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অংশ হিসেবে মনে করতেন। তাই অথবিদ্যাকে পৃথক শারে হিসেবে বর্ণনা না করে তাকে বলা হত Political Economy বা রাজনৈতিক অর্থনীতি। রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করতে গেলে তার অর্থনীতির বুনিয়াদকে শক্তিশালী করা প্রয়োজন। দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো দুর্বল হলে প্রাপ্ত দুর্বল হবে। কারণ, কল্যাণকর অর্থনীতির উপর বাষ্ট্রে সমৃদ্ধি নির্ভর করে। উন্নয়নশীল দেশগুলির পক্ষে একথা সর্বাংশে সত্য। প্রকৃতপক্ষে, উভয়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। কারণ –
প্রথমত, উভয় শাই সমাজবদ্ধ মানুষের জীবনে সর্বাধিক কল্যাণ প্রতিষ্ঠাকেই নৌীল লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করে। মৌল লক্ষ্যের এই অভিযতার জন্য উভা শাল পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত। মানুষের রাজনৈতিক জীবন ও অর্থনৈতিক জীবনকে বিচ্ছিন্ন করে চিন্তা করা যায় না। রাষ্ট্র আইন তৈরি করে মানুষের কল্যাণের জন্য। অর্থনীতির উদ্দেশ্য হল, মানুষের অর্থনৈতিক মঙ্গল সাধন করা।
দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রবিজ্ঞান যেমন অর্থবিদ্যাকে প্রভাবিত করে, ঠিক তেমনই অথবিদ্যাও রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে প্রভাবিত করে থাকে। দেশের অর্থনীতি রাজনীতির উপর নির্ভরশীল। ব্যাংক জাতীয় করা হবে কি না তা রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করে। আবার দেশের রাজনীতি অর্থনীতির উপর নির্ভরশীল। যেমন—অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দিলে, রাজনৈতিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পাবে।
তৃতীয়ত, রাজনৈতিক মতাদর্শের উপর অর্থনৈতিক কর্মসূচি গড়ে ওঠে। যেমন-যে দেশ উদারনৈতিক গণতন্ত্রের সমর্থক, সে দেশ মিশ্র অর্থনীতি গ্রহণ করবে। যারা সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের সমর্থক, তারা সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি গ্রহণ করবে। আবার অন্যদিকে অর্থনৈতিক তত্ত্ব, রাজনৈতিক কাঠামাে গড়ে তােলে। যেমন—মার্কসবাদীতত্ত্ব সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তুলেছে।
চতুর্থত, রাজনৈতিক গণতন্ত্রে আস্থাশীল অনেক দেশেই একটি প্রতিষ্ঠান একই সঙ্গে উভয় শাস্ত্রের পঠনপাঠন ও গবেষণার জন্য গড়ে উঠেছে। এদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল লন্ডনের অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠান এবং কানাডার অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠান।
প্রশ্ন: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সঙ্গে মনােবিজ্ঞানের কোন কোন ক্ষেত্রে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে?
উত্তর: আধুনিক কালের রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা মনে করেন, “রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও মনােবিজ্ঞান পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।” এদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলেন টার্ডে, গ্রাহাম ওয়ালাস, বেজহট প্রভৃতি। এদের যুক্তি হল-
প্রথমত, সরকারের স্থায়িত্ব, শাসনব্যবস্থার সাফল্য প্রভৃতির ক্ষেত্রে জনগণের ধ্যানধারণা ও বিশ্বাস প্রভৃতি জানা দরকার। এর জন্য মনােবিজ্ঞানের আশ্রয় নিতে হবে। সেই কারণে বর্তমানে শুধু সরকার নয়, রাজনৈতিক দলগুলি ক্ষমতালাভের উদ্দেশ্যে মনােবিজ্ঞানের সাহায্য নিয়ে রাজনৈতিক প্রচারকার্য চালান। তাই লর্ড ব্রাইস বলেছেন-“Political Science has its roots in Psychology.” অর্থাৎ মনােবিজ্ঞানের মধ্যে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মূল নিহিত।
দ্বিতীয়ত, বর্তমানকালে ধর্মীয় বিশ্বাস, ভাবপ্রবণতা প্রভৃতি কারণে রাজনৈতিক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। রামমন্দির, বাবরি মসজিদ, খালিথান আন্দোলন প্রভৃতি এর উদাহরণ। এগুলির মােকাবিলা করতে গেলে মনােবিজ্ঞানের সাহায্য নেওয়া প্রয়ােজন।
তৃতীয়ত, গণতন্ত্রের প্রাণ হল জনমত। জনমত যত বলিষ্ঠ হবে, ততই গণতন্ত্র সফল হবে। রাজনৈতিক দলগুলিও জনমতকে প্রভাবিত করতে চেষ্টা করে। একাজ করতে গেলে জনগণের মানসিক প্রবণতা জানা প্রয়ােজন। মনােবিজ্ঞানের মাধ্যমে এটি সম্ভব।
চতুর্থত, জাতীয়তাবোেধ জাতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। জাতির প্রতি ভালােবাসার নাম জাতীয়তাবােধ। এটি একটি ভাবগত ধারণা। এই চেতনার বা মানসিকতার সৃষ্টির জন্য মনােবিজ্ঞানের সাহায্য নেওয়া দরকার। পঞ্চমত, শাসনব্যবস্থার সাফল্য নির্ভর করবে সরকারি আইন বা নীতি জনগণ কতটা মেনে নেবে তার উপর। যদি কোনাে আইন জনগণের মনে না ধরে, তাহলে তাদের মধ্যে অসন্তোষ বৃদ্ধি পাবে। তাতে রাষ্ট্রের ভিত দুর্বল হবে। তাই শাসনব্যবস্থার সাফল্যের জন্য মনােবিজ্ঞানের সাহায্য নেওয়া প্রয়ােজন।
প্রশ্ন: রাজনীতির সাবেকি ধারণা ও আধুনিক ধারণার মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করাে।
উত্তর: রাজনীতির সাবেকি ধারণার সঙ্গে আধুনিক ধারণার নানা দিক থেকে পার্থক্য রয়েছে। যেমন-
প্রথমত, সাবেকি ধারণায় রাজনীতি হল একটি মানবিক ক্রিয়া, কিন্তু তা কখনও সর্বজনীন নয়। কিন্তু আধুনিক ধারণায় রাজনীতি একটি সর্বজনীন মানবিক ক্রিয়া।
দ্বিতীয়ত, সাবেকি ধারণায় রাজনীতি রাষ্ট্রকেন্দ্রিক অর্থাৎ এখানে রাজনীতি রাজনৈতিক। কিন্তু আধুনিক ধারণায় রাজনীতি সমাজকেন্দ্রিক বা সামাজিক। অর্থাৎ রাজনীতি অরাজনৈতিক।
তৃতীয়ত, সাবেকি ধারণায় রাষ্ট্রের প্রভাব, ক্ষমতা ও আধিপত্য এবং তাদের ঘিরে যাবতীয় রাজনৈতিক সংগঠন ও তাদের কাজকর্ম—এই হল রাজনীতির উপাদান। কিন্তু আধুনিক ধারণায়, সমাজের যে-কোনাে ধরনের বিরােধ ও তার নিষ্পত্তি হল রাজনীতির উপাদান।
চতুর্থত, সাবেকি ধারণায় শুধু জনসম্পর্কিত বিষয়ই রাজনীতির অন্তর্ভুক্ত। অপরদিকে, আধুনিক ধারণায় জনসম্পর্কিত বিষয় ছাড়াও ব্যক্তিগত ও একান্ত বিষয়ও রাজনীতির অন্তর্ভুক্ত।
পঞ্চমত, সাবেকি ধারণায় রাজনীতি মূল্যবােধের দ্বারা লালিত। অপরদিকে, আধুনিক ধারণায়। রাজনীতি মূল্যবােধ-নিরপেক্ষ।
যষ্ঠত, সাবেকি ধারণায় রাষ্ট্রীয় ক্রিয়া রূপে রাজনীতির সক্রিয়তার এলাকা তুলনামূলকভাবে অনেক ছােটো। অপরদিকে, আধুনিক ধারণা সামাজিক ক্রিয়া হিসেবে রাজনীতির সক্রিয়তার এলাকা তুলনামূলকভাবে অনেক বড়াে।
প্রশ্ন: ইতিহাস এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মধ্যে পার্থক্য কোথায় ?
উত্তর: ইতিহাস এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মধ্যে গভীর সম্পর্ক থাকলেও দুটি শাস্ত্রের মধ্যে বিভিন্ন দিকে পার্থক্য বর্তমান। যেমন-
প্রথমত, ইতিহাসের আলােচনার বিষয়বস্তু অনেক বেশি। কারণ: ইতিহাস রাজনীতি, সংস্কৃতি, সাহিত্য, ধর্ম প্রভৃতি নিয়ে আলােচনা করে। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞান মানুষের শুধু রাজনৈতিক দিক নিয়ে আলােচনা করে।
দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমন মতবাদ আছে—যা ইতিহাসে পাওয়া যায় না। যেমন: ঐশ্বরিক মতবাদ, সামাজিক চুক্তি মতবাদ প্রভৃতি। তাই দুটি শাস্ত্র এক নয়।
তৃতীয়ত, ইতিহাস বর্ণনামূলক অর্থাৎ যা ঘটেছে, তা বর্ণনা করে। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞান যা হওয়া উচিত, তাও আলােচনা করে। ইতিহাস উচিত-অনুচিত বিষয় নিয়ে আলােচনা করে না।
চতুর্থত, ইতিহাস ধারাবাহিকভাবে ঘটনা পরিবেশন করে। অর্থাৎ সময়কাল ধরে সাজিয়ে পরপর ঘটনাগুলি বর্ণনা করে। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞান ধারাবাহিকতা বজায় রাখে না। যেমন: গণতন্ত্র সম্পর্কে আলােচনা করতে গিয়ে একই সঙ্গে তার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে আলােচনা করে।
পঞ্চমত, রাষ্ট্রবিজ্ঞান শুধুমাত্র ইতিহাস থেকে উপাদান সংগ্রহ করে না। অন্যান্য শাস্ত্র থেকেও উপাদান সংগ্রহ করে। যেমন: রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলােচনার ক্ষেত্রে অর্থনীতি, সমাজনীতি, পরিসংখ্যান প্রভৃতি বিভিন্ন শাস্ত্রের সাহায্য নিয়ে থাকে।
প্রশ্ন: মার্কসবাদের সঙ্গে উদারনীতিবাদের পার্থক্য কী?
উত্তর: প্রথমত, মার্কসবাদীরা রাষ্ট্রনীতির বৈপ্লবিক তত্ত্বের কথা বলেন। কিন্তু উদারনীতিবাদীরা রাষ্ট্রনীতির দ্বন্দ্ব ও সহযােগিতার তত্ত্বে বিশ্বাসী। দ্বিতীয়ত, বৈপ্লবিক তত্ত্ব শ্রেণিসংগ্রামের ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত এবং বৈপ্লবিক প্রকৃতির মধ্যেই রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কিত মার্কসীয় ধারণার মূল নিহিত আছে। মার্কসীয় তত্ত্বে বিপ্লব একই সঙ্গে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। এই দুইয়ের মধ্যে কোনাে পার্থক্য নেই। কিন্তু উদারনৈতিক তত্ত্বে বিপ্লব কেবলমাত্র রাজনৈতিক প্রক্রিয়া।
তৃতীয়ত, বিপ্লবের ফলে সরকার, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির পরিবর্তন ঘটে। বিপ্লব মানেই একটি নির্দিষ্ট উৎপাদন ব্যবস্থা ও সমাজ পদ্ধতি থেকে উন্নততর উৎপাদন ব্যবস্থা ও সমাজ পদ্ধতির রূপান্তর। প্রতিষ্ঠিত হবে শ্রেণিহীন সমাজ। শ্রেণিসংঘাত থাকবে না। রাষ্ট্রের আর প্রয়ােজন হবে না। প্রতিষ্ঠিত হবে সমাজতন্ত্র। এই স্তরে বদলে যাবে রাষ্ট্রনীতির অর্থ। সামাজিক মানুষ হবে মুক্ত ও স্বাধীন। পক্ষান্তরে, উদারনীতিবাদীদের মতে, বিপ্লবের সঙ্গে প্রগতির কোনাে সম্পর্ক নেই। আধুনিক উদারনীতিবাদীরা প্রগতির এই ধারণাকেই অস্বীকার করেন।
এই দুই তত্ত্ব বিশ্লেষণ করলে আমরা এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, মার্কসীয় তত্ত্বটিই একমাত্র তত্ত্ব যার সাহায্যে ইতিহাসের বিভিন্ন বিপ্লবের ঘটনাকে সাধারণ বৈজ্ঞানিক সূত্রের দ্বারা ব্যাখ্যা কর। যায়। এখানেই এই তত্ত্বের গুরুত্ব, তাৎপর্য, মূল্য যা উদারনীতিবাদীরা অস্বীকার করতে পারেন না।
প্রশ্ন: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সঙ্গে সমাজবিদ্যার পার্থক্য লেখাে।
উত্তর: রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিদ্যার মধ্যে সম্পর্ক গভীর হলেও উভয় শাস্ত্রের মধ্যে পার্থক্য বর্তমান। নিম্নে সেগুলি আলােচিত হল-
প্রথমত, সমাজবিদ্যার আলােচনার বিষয়বস্তু অনেক বেশি। পরিবার, গােষ্ঠী প্রভৃতি সমাজের সব রকমের সংগঠন নিয়ে এই শাস্ত্র আলােচনা করে। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞান শুধুমাত্র রাজনৈতিক সংগঠন নিয়ে আলােচনা করে।
দ্বিতীয়ত, সমাজবিদ্যার জন্ম অনেক আগে হয়েছে। মানুষ যখন সমাজ গঠন করতে শিখল, তখন সমাজবিদ্যার জন্ম। তার অনেক পরে যখন রাষ্ট্রের উৎপত্তি হল, তখন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সূত্রপাত হল।
তৃতীয়ত, সমাজবিদ্যা মানুষের জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলােচনা করে। যেমন—পারিবারিক দিক, অর্থনৈতিক দিক প্রভৃতি। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞান শুধু তার রাজনৈতিক দিক নিয়ে আলােচনা করে।
চতুর্থত, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বাস্তব অবস্থা ছাড়া আদর্শ রাষ্ট্রের প্রকৃতি নিয়ে আলােচনা করে। যেমন— রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্লেটো তাঁর বিশিষ্ট গ্রন্থে আদর্শ রাষ্ট্রের বর্ণনা করেছেন। কিন্তু সমাজবিদ্যা শুধুমাত্র বাস্তব সমাজের অবস্থা নিয়ে আলােচনা করে।
প্রশ্ন: রাষ্ট্রনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বলতে কী বােঝ?
উত্তর: গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল (Aristotle) রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে রাষ্ট্রনীতি নামে অভিহিত করেন। অ্যারিস্টটলের গ্রন্থটির নাম হল ‘পলিটিকস’ (Politics)। এছাড়া সিজউইক (Sidgwick), অ্যাক্টন (Acton), লিপসন (Lipson) প্রমুখরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিবর্তে রাষ্ট্রনীতি শব্দটিকে ব্যবহার করেন।
গ্রিক শব্দ পলিশ (Polis) থেকে Politics শব্দটি উদ্ভূত। পলিশ-এর অর্থ হল নগর। সুতরাং নগররাষ্ট্র ও তার সমস্যার আলােচনা হল রাষ্ট্রনীতি বা Politics ।
কিন্তু আধুনিক যুগে রাষ্ট্রীয় জীবন জটিল হওয়ার দরুন রাষ্ট্রনীতির পরিবর্তে অনেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান শব্দটি প্রয়ােগ করার পক্ষপাতী। সামগ্রিকভাবে মানুষের রাজনৈতিক জীবনের সুবিন্যস্ত আলােচনাই হল রাষ্ট্রবিজ্ঞান। অধ্যাপক গিলক্রাইস্ট (Gilchrist) বর্তমানে ভিন্ন অর্থে রাষ্ট্রনীতি শব্দটি প্রয়ােগ করেন। তাঁর মতে সরকারি নীতি নির্ধারণ ও প্রয়ােগকে রাষ্ট্রনীতি বলা হয়। পােলক রাষ্ট্রনীতিকে দু-ভাগে বিভক্ত করেন তত্ত্বগত রাষ্ট্রনীতি ও ব্যাবহারিক রাষ্ট্রনীতি। তত্ত্বগত রাষ্ট্রনীতি শুধুমাত্র রাষ্ট্র, সরকার, আইন ইত্যাদি সম্পর্কে তাত্ত্বিক আলােচনা করে। কিন্তু ব্যাবহারিক রাষ্ট্রনীতি রাজনৈতিক কৌশল নিয়ে আলােচনা করে। রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্রনীতির তুলনায় অধিকতর ব্যাপক। অধ্যাপক গার্নারের (Garner) মতে রাষ্ট্রের ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত জ্ঞান হল রাষ্ট্রবিজ্ঞান। অন্যদিকে, বাস্তব প্রশাসনের সঙ্গে সংযুক্ত কার্যাবলি হল রাষ্ট্রনীতি।
প্রশ্ন: রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং নীতিশাস্ত্রের মধ্যে পার্থক্য লেখো।
উত্তর: গ্রিক দার্শনিকগণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে নীতিশাস্ত্রের অন্যতম শাখা হিসেবে গণ্য করতেন। তাঁদের মতে জনগণের জন্য মঙ্গলময় সুন্দর জীবন সম্ভব করে তােলাই হল রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য। অধ্যাপক ম্যাকেঞ্জির (W.J.M. Mackenjie) মতে, আচার-আচরণের ভালােমন্দের আলােচনাই হল নীতিশাস্ত্র। ইটালির দার্শনিক মেকিয়াভেলি (Machiavelli) রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে পৃথক শাস্ত্রের মর্যাদা দেন। আধুনিক কালে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও নীতিশাস্ত্রের মধ্যে বহুক্ষেত্রে পার্থক্য লক্ষ করা যায়। যেমন:
প্রথমত, নীতিশাস্ত্র মানুষের চিন্তা ও বাহ্যিক আচার-আচরণ উভয়কে নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞান কেবল মানুষের বাহ্যিক কার্যকলাপ নিয়ে আলােচনা করে।
দ্বিতীয়ত, নীতিশাস্ত্রের নির্দেশ হল ন্যায়ভিত্তিক। ন্যায়-অন্যায় বােধ থেকে নীতিশাস্ত্রের প্রতিপাদ্য সূত্রগুলির সৃষ্টি হয়। কিন্তু রাষ্ট্রের দৃষ্টিতে যা বেআইনি কাজ তা নীতিবিরুদ্ধ নাও হতে পারে।
তৃতীয়ত, ন্যায়নীতি বােধ সকল রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে প্রায় একই রকম কিন্তু রাষ্ট্রীয় আইন দেশভেদে ভিন্ন রকম হতে পারে। চতুর্থত, রাষ্ট্রীয় আইন বাধ্যতামূলক। কিন্তু নৈতিক বিধান বাধ্যতামূলক নয়। পঞ্চমত, রাষ্ট্রবিজ্ঞান নবীন শাস্ত্র। কিন্তু নীতিশাস্ত্র রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তুলনায় প্রাচীন শাস্ত্র।
রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর
প্রশ্ন: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রকৃতি ও পরিধি (বিষয়বস্তু) আলােচনা করো।
উত্তর: রাষ্ট্রবিজ্ঞান একটি গতিশীল সামাজিক বিজ্ঞান। সমাজের পরিবর্তন ঘটে। এই পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচনার বিষয়বস্তুরও পরিবর্তন হয়। সমাজ যতই জটিল হচ্ছে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। পুরাতন বিষয়বস্তুর পাশাপাশি নতুন বিষয়বস্তু যুক্ত হচ্ছে। এইভাবে পুরানাে ও নতুন বিষয়বস্তুর সমন্বয় করে আমরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচনার পরিধি বা বিষয়বস্তুকে নিম্নলিখিত ভাগে আলােচনা করতে পারি।
(ক) রাষ্ট্র নিয়ে আলােচনা
রাষ্ট্রবিজ্ঞান হলরাষ্ট্র-সম্পর্কিত বিজ্ঞান। তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচ্য বিষয়বস্তু হল রাষ্ট্র। গার্নারের ভাষায় বলা যায়—“Political Science begins and ends with the State,” অর্থাৎ রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্র নিয়ে আলােচনা শুরু ও শেষ করে। রাষ্ট্রের আলােচনা বলতে বােঝায়—কীভাবে রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়েছে, রাষ্ট্রের প্রকৃতি কেমন ইত্যাদি। রাষ্ট্রের উপর গুরুত্ব আরােপ করার কারণ হল, অ্যারিস্টটল থেকে শুরু করে হত্স, হেগেল প্রভৃতি চিন্তাবিদরা বলেছেন রাষ্ট্রের মধ্যে থেকেই মানুষের বিকাশ সম্ভব। তাই অ্যারিস্টটল বলেছেন, যে মানুষ সমাজের মধ্যে বাস করে না সে হয় দেবতা, না হয় পশু। এই সমাজের শ্রেষ্ঠ সংগঠনই হল রাষ্ট্র। তাই রাষ্ট্রের আলােচনার গুরুত্ব অনেক বেশি।
(খ) সরকার নিয়ে আলােচনা
রাষ্ট্রবিজ্ঞান সরকার নিয়ে আলােচনা করে। কারণ, রাষ্ট্রের ইচ্ছা সরকারের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পায়। তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচনার অন্যতম বিষয়বস্তু হল সরকার। তাই গিলক্রাইস্ট (Gilchrist) বলেছেন “Political Science deals with State and Government, poffe sig fra Prat আলােচনা করে। সরকারের আলােচনা বলতে বােঝায়, কী কী ধরনের সরকার আছে, তাদের প্রকৃতি কেমন, তাদের দোষগুণ কী কী ইত্যাদি নিয়ে আলােচনা।
(গ) আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান নিয়ে আলােচনা
বর্তমানে বিশ্ব রাজনীতিতে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে জাতিপুঞ্জ ও তার শাখাগুলি বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে সহযােগিতার মাধ্যমে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নতি ঘটানাে এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এই প্রতিষ্ঠান উল্লেখযােগ্য ভূমিকা নিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই প্রতিষ্ঠান মূল কেন্দ্র হিসেবে কাজ করছে। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সদস্যপদ পাওয়ায় এই প্রতিষ্ঠানের ভূমিকার ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হয়েছে। তাই এইসব প্রতিষ্ঠান ও তার কার্যকলাপ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু।
(ঘ) ব্যক্তিগত ও গােষ্ঠীগত আচরণ নিয়ে আলােচনা
মানুষের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কার্যকলাপ তার মানসিক কাঠামাে, ব্যক্তিগত ও গােষ্ঠীগত আচার- আচরণ দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়। সেই কারণে বর্তমানে রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলােচনার ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ও গােষ্ঠীগত আচরণ, রাজনৈতিক দলের ভূমিকা, চাপ সৃষ্টিকারী গােষ্ঠীর কার্যকলাপ, নির্বাচকমণ্ডলীর আচরণ প্রভৃতি স্থান পাচ্ছে। এইসব রাজনৈতিক কার্যকলাপ ও আচার-আচরণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু।
(ঙ) মূল্যবােধ নিয়ে আলােচনা
তথ্যানুসন্ধানের সঙ্গে সঙ্গে, ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধির পথ দেখানাে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের নৈতিক দায়িত্ব। রবসন (Robson) বলেছেন-রাষ্ট্রবিজ্ঞান শুধু কী আছে, তা নিয়ে আলােচনা করে না, কী হওয়া উচিৎ তাও বলে। অর্থাৎ রাষ্ট্রবিজ্ঞান উচিত-অনুচিত বা মূল্যবােধের উপর গুরুত্ব আরােপ করে।
(চ) ক্ষমতা নিয়ে আলােচনা
রাষ্ট্রবিজ্ঞান ক্ষমতা নিয়ে আলােচনা করে। কারণ, রাজনীতির মূল কথা হল ক্ষমতা। ম্যাক্স ওয়েবার বলেছেন—“Parties live in a house of Power” অর্থাৎ রাজনৈতিক দলগুলি ক্ষমতার দুর্গে বাস করতে চায়। কেবল জাতীয় ক্ষেত্রে নয়, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও ক্ষমতার লড়াই চলছে। তাই ক্ষমতাও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু।
(ছ) আইন নিয়ে আলােচনা
রাষ্ট্র হল একটি আইনমূলক প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রের প্রধান কাজ হল আইন তৈরি করা এবং সেই আইনকে কার্যকর করা। রাষ্ট্রের তৈরি আইন আদালত কর্তৃক বলবৎযােগ্য। অর্থাৎ এই আইন কেউ ভঙ্গ করলে রাষ্ট্র তাকে শাস্তি দেবে। তাই আইন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু।
(জ) রাষ্ট্রের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে আলােচনা
রাষ্ট্রের অতীত জানা দরকার। রাষ্ট্রের অতীত ও বর্তমান অবস্থা আলােচনার মাধ্যমে ভবিষ্যতে কী ঘটতে পারে তার সম্পর্কে ইঙ্গিত দেওয়া যায়। গেটেল বলেছেন—“It is thus a Study of the State in the Past, Present and Future,”অর্থাৎ রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্রের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত নিয়ে আলােচনা করে।
(ঝ) শ্রেণিগত সম্পর্ক নিয়ে আলােচনা
বৈষম্যমূলক সমাজে শ্রেণিতে-শ্রেণিতে সংগ্রাম অবিরাম চলতে থাকে। মার্কস-এর ভাষায় বলা যায়— মানুষের সমাজের ইতিহাস হল শ্রেণি সংগ্রামের ইতিহাস। এটি ঐতিহাসিক সত্য। তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমাজে শ্রেণির উদ্ভব, বিকাশ এবং শ্রেণিদ্বন্দ্ব ও তার পরিণতি নিয়ে আলােচনা করে।
মূল্যায়ন
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিধি অত্যন্ত ব্যাপক। ১৯৪৮ সালে UNESCO আয়ােজিত এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচনার বিষয়বস্তুকে মােট চারটি ভাগে ভাগ করেছেন—(ক) রাজনৈতিক তত্ত্ব ও তার ইতিহাস, (খ) রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ, (গ) রাজনৈতিক মতবাদ ও দল এবং (ঘ) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান গতিশীল বিজ্ঞান। তাই এর বিষয়বস্তু ও আলােচনার ক্ষেত্র ছােটো গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ নয়। সমাজে ও রাষ্ট্রে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এই সমস্যা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচনায় স্থান পাচ্ছে। তার ফলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচনার পরিধি ধীরে ধীরে প্রসারিত হচ্ছে।
প্রশ্ন: রাষ্ট্রবিজ্ঞান কি বিজ্ঞান-পদবাচ্য? তােমার উত্তরের সপক্ষে যুক্তি দাও।
উত্তর: রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে বিজ্ঞান বলা যায় কি না এ সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। অ্যারিস্টটল রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে শুধু বিজ্ঞান বলেননি, একে শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান (Master Science) বলে বর্ণনা করেছেন। অপরদিকে, মেটল্যান্ড দুঃখ করে বলেছেন “আমি যখন কোনাে পরীক্ষায় এমন প্রশ্নপত্র দেখি, যার শিরােনাম রাষ্ট্রবিজ্ঞান, তখন প্রশ্নগুলির জন্য দুঃখ হয় না, দুঃখ হয় ওই শিরােনামটির জন্য। সুতরাং দেখা যাচ্ছে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিজ্ঞান কি না সে সম্পর্কে বিতর্ক আছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিজ্ঞান নয় কারণ:
প্রথমত, সাধারণ বিজ্ঞানে যে বিষয় নিয়ে গবেষণা করা হয়, তার হঠাৎ পরিবর্তন হয় না। তাই গবেষণা বা পরীক্ষানিরীক্ষার সুবিধা আছে। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞান মানুষকে নিয়ে আলােচনা করে। মানুষের চিন্তাভাবনা পরিবর্তনশীল। কারণ, তারা আবেগ ও অনুভূতির দ্বারা পরিচালিত হয়। তাই এখানে গবেষণার ব্যাঘাত ঘটে। আর ব্যাঘাত ঘটে বলে এটি বিজ্ঞানের মর্যাদা দাবি করতে পারে না।
দ্বিতীয়ত, সাধারণ বিজ্ঞানে সর্বজনগ্রাহ্য সূত্র বের করা যায়। যেমন, জলের সূত্র হল HOT এটি সর্বজন স্বীকৃত। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এরূপ সর্বজনগ্রাহ্য সূত্র বের করা যায় না। যেমন, একদলীয় ব্যবস্থা বা দ্বিদলীয় ব্যবস্থার মধ্যে কোন্টি কাম্য, এ বিষয়ে ঐকমত্য নেই।
তৃতীয়ত, সাধারণ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে গবেষণার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা যায়। এতে গবেষণার সুবিধা হয়। যেমন, কোনাে বিষয়ের গবেষণার জন্য ঠান্ডা ঘরের প্রয়ােজন হলে তা করা। সম্ভব। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এই সুবিধা নেই। কারণ, এর ক্ষেত্র ও পরিধি অনেক ব্যাপক।
চতুর্থত, সাধারণ বিজ্ঞানের মতাে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচনার বিভিন্ন পদ্ধতি আছে। যেমন, পরীক্ষামূলক পদ্ধতি, তুলনামূলক পদ্ধতি প্রভৃতি। কিন্তু এগুলি অনেক সময় সাধারণ বিজ্ঞানের মতাে নির্ভুল সিদ্ধান্ত দিতে পারে না।
পঞ্চমত, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গবেষণার কাজে অনেক সময় অসুবিধার সৃষ্টি হয়। যেমন—দাসত্ব প্রথায় দাসরা কীভাবে অত্যাচারিত হত এবং তার প্রতিক্রিয়া কী হত, সে সম্পর্কে গবেষণা ও পরীক্ষানিরীক্ষা করতে গেলে গবেষকদের অসুবিধার মধ্যে পড়তে হতে পারে।
ষষ্ঠত, সাধারণ বিজ্ঞানের বিষয়গুলিকে গবেষণার সুবিধার জন্যে ছােটো ছােটো অংশে ভাগ করা এবং পরিমাপ করা সম্ভব। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তেমন সম্ভব নয়। যেমন- জনমতকে পরিমাপ করার যন্ত্র এখনও আবিষ্কৃত হয়নি।
সপ্তমত, সাধারণ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মূল্যমানের (value) প্রয়ােজন হয় না। অর্থাৎ বিষয়বস্তু পরীক্ষানিরীক্ষার ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ভালােমন্দের অবকাশ নেই। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে উচিত-অনুচিত, ভালােমন্দের আলােচনা থাকে। তাই একে সাধারণ বিজ্ঞানের পর্যায়ে ফেলা যায় না।
বিজ্ঞান না বলার পিছনে যুক্তি দেখানাে হলেও প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রবিজ্ঞান একটি বিজ্ঞান। কারণ-
প্রথমত, সাধারণ বিজ্ঞানের মতাে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সাধারণ সূত্র বের করা সম্ভব। যেমন, অ্যারিস্টটল বলেছেন যে সমাজের মধ্যে বৈষম্য থাকলে বিক্ষোভ দেখা দিতে পারে। অ্যারিস্টটলের দেওয়া এই বিজ্ঞানসম্মত সূত্র কেউ অস্বীকার করতে পারবে না।
দ্বিতীয়ত, সাধারণ বিজ্ঞানের মতাে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিষয়বস্তুর শ্রেণিবিভাগ, বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ করা যায়। যেমন, অ্যারিস্টটল ১৫৮টি নগর-রাষ্ট্রের সংবিধানের তুলনামূলক আলােচনা করে যে সূত্র প্রতিষ্ঠা করে গেছেন, তা অস্বীকার করা যাবে না।
তৃতীয়ত, লর্ড ব্রাইস বলেছেন- মানুষের রাজনৈতিক আচরণ জটিল হলেও তার মধ্যে বিশেষ সামঞ্জস্য দেখা যায়। এই সামঞ্জস্যপূর্ণ আচরণ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সাধারণ সূত্র বা নিয়ম নির্ধারণ করা যায়।
চতুর্থত, আধুনিককালের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরীক্ষার ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়ােগ করা সম্ভব হচ্ছে। পরিসংখ্যান ও গাণিতিক তত্ত্ব প্রয়ােগ করে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। আচরণবাদীরা এই তত্ত্ব প্রয়ােগের পক্ষপাতি। চার্লস মেরিয়াম, ল্যাসওয়েল প্রভৃতি আচরণবাদীরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচনার ক্ষেত্রে এই পরিসংখ্যান পদ্ধতি গ্রহণ করেছেন। প্রণয় রায় এই পদ্ধতি প্রয়ােগ করে ভারতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের ধারা প্রবাহিত করেছেন।
মূল্যায়ন
সাধারণ বিজ্ঞানের মতাে বৈশিষ্ট্য থাকার জন্যে অ্যারিস্টটল, পােলক, গেটেল প্রভৃতি। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে বিজ্ঞান বলেছেন। তবে একথা সত্য, এটি এখনও পদার্থবিদ্যা বা রসায়নবিদ্যার মতাে সম্পূর্ণ বিজ্ঞান হয়ে ওঠেনি। কারণ, অনেক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে অনুমানের উপর নির্ভর করতে হয়। এই অনুমান সবসময় সত্য হয় না। যেমন, নির্বাচনে কোন দল কত আসন পাবে সে ব্যাপারে পূর্বে সুনিশ্চিতভাবে কিছু বলা সম্ভব নয়। তাই লর্ড ব্রাইস রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে আবহবিদ্যার মতাে অসম্পূর্ণ বিজ্ঞান বলেছেন। আবহবিদ্যায় মেঘ, বৃষ্টি, ঝড় সম্পর্কে ভবিষ্যত্বাণী সুনিশ্চিত নয়, অথচ সেটি বিজ্ঞান। তেমনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সিদ্ধান্ত সুনিশ্চিত নয়। তাই একে বিজ্ঞান না বলার যুক্তি নেই। তবে এটি একটি অসম্পূর্ণ সামাজিক বিজ্ঞান। বর্তমানে এটি পূর্ণতার দিকে এগিয়ে চলেছে।
প্রশ্ন: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সঙ্গে ইতিহাসের কী সম্পর্ক তা নির্দেশ করে।
অথবা,
“রাষ্ট্রবিজ্ঞান ছাড়া ইতিহাসের আলােচনা নিষ্ফল এবং ইতিহাস ছাড়া রাষ্ট্রবিজ্ঞান ভিত্তিহীন।” আলােচনা করাে।
উত্তর: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সঙ্গে ইতিহাসের সম্পর্ক নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাসের সংজ্ঞার প্রেক্ষাপটে উভয়ের মধ্যে সম্পর্ক আলােচনা করা যেতে পারে। যে শাস্ত্র রাষ্ট্র নিয়ে আলােচনা করে, তাকে বলা হয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান। অপরদিকে, ইতিহাস হল। অতীতের ঘটনাবলি, অতীতের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিবরণ। এই সংজ্ঞা দুটির আলােকে উভয়ের মধ্যে সম্পর্ক নিম্নে আলােচিত হল-
উভয়ের মধ্যে গভীর সম্পর্ক
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সঙ্গে ইতিহাসের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাসের সম্পর্ক কতটা ঘনিষ্ঠ তা বােঝাতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সিলি (Seeley) মন্তব্য করেছেন—“রাষ্ট্রবিজ্ঞান ছাড়া ইতিহাসের আলােচনা নিষ্ফল এবং ইতিহাস ছাড়া রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলােচনা ভিত্তিহীন।” এই উক্তির মধ্যে অতিরঞ্জন থাকলেও এর সত্যতা স্বীকার করতে হয়।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান ইতিহাসের কাছে ঋণী
প্রথমত, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ইতিহাস থেকে নানা তথ্য ও উপাদান সংগ্রহ করে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সূত্র গড়ে তােলে। যেমন, ইতিহাস থেকে একনায়কের কার্যাবলি বিশ্লেষণ করে একনায়কতন্ত্রের দোষ-গুণ নির্ধারণ করা হয়। তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞান ইতিহাসের নিকট ঋণী।
দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্র নিয়ে আলােচনা করে। কিন্তু রাষ্ট্র সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করতে গেলে রাষ্ট্র পূর্বে কেমন ছিল, কীভাবে বর্তমান অবস্থায় এসেছে, তা জানা প্রয়ােজন। এর জন্যে ইতিহাসের আশ্রয় নিতে হবে।
তৃতীয়ত, ইতিহাসের ঘটনার পটভূমিতে অনেকসময় রাজনৈতিক মতবাদ গড়ে ওঠে। যেমন, হবসের “লেভিয়াথান গ্রন্থ” ও “সামাজিক চুক্তি মতবাদ” ইংল্যান্ডে ঐতিহাসিক ঘটনার পটভূমিতে জন্ম নিয়েছিল।
চতুর্থত, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জেলিনেক (Jellinek) বলেছেন—রাষ্ট্রের মধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান থাকে। তাদের কাজের মূল্যায়ন করতে গেলে অতীতে তারা কী ধরনের কাজ করত তা জানা দরকার। ইতিহাস এগুলি আমাদের জানাতে সাহায্য করে বলে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ইতিহাসের কাছে ঋণী।
ইতিহাস রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কাছে ঋণী
প্রথমত, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ইতিহাসের মর্যাদা বৃদ্ধি করেছে। কারণ রাষ্ট্রবিজ্ঞান একটি গতিশীল বিজ্ঞান। এর কদর দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই বিজ্ঞানের জন্মদাতা হিসাবে ইতিহাসের গৌরব বৃদ্ধি পেয়েছে। এই গৌরব বৃদ্ধির কারণে ইতিহাস রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কাছে ঋণী।
দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রবিজ্ঞান থেকে তথ্য সংগ্রহ করে ইতিহাস সমৃদ্ধ হয়েছে। যেমন, অনুন্নত দেশের রাজনৈতিক আন্দোলন সে দেশের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে। সেদিক থেকে ইতিহাস রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কাছে ঋণী।
তৃতীয়ত, রাজনৈতিক মতাদর্শ ইতিহাসের গতি নির্ধারণ করে। যেমন, মার্কসের মতবাদ রাশিয়ায় বিপ্লব ঘটিয়ে সে দেশের ইতিহাসের গতিপথ পরিবর্তন করেছে। তাই ইতিহাস রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কাছে ঋণী।
উভয় শাস্ত্রের সীমারেখা
উভয়ের মধ্যে সম্পর্ক থাকলেও দুটি শাস্ত্র এক নয়। কারণ-
প্রথমত, ইতিহাসের আলােচনার বিষয়বস্তু অনেক বেশি। কারণ—ইতিহাস রাজনীতি, সংস্কৃতি, সাহিত্য, ধর্ম প্রভৃতি আলােচনা করে। কিন্তু, রাষ্ট্রবিজ্ঞান মানুষের শুধু রাজনৈতিক দিক আলোচনা করে।
দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমন মতবাদ আছে, যা ইতিহাসে পাওয়া যায় না। যেমন, ঐশরিক মতবাদ, সামাজিক চুক্তি মতবাদ প্রভৃতি। তাই দুটি শাস্ত্র এক নয়।
তৃতীয়ত, ইতিহাস বর্ণনামুলক। অর্থাৎ যা ঘটেছে, তা বর্ণনা করে। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞান যা হওয়া উচিত, তাও আলােচনা করে। ইতিহাস উচিত-অনুচিত বিষয় নিয়ে আলােচনা করে না।
চতুর্থত, ইতিহাস ধারাবাহিকভাবে ঘটনা পরিবেশন করে। অর্থাৎ সময়কাল ধরে সাজিয়ে পরপর ঘটনাগুলি বর্ণনা করে। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞান ধারাবাহিকতা বজায় রাখে না। যেমন, গণতন্ত্র সম্পর্কে আলােচনা করতে গিয়ে একইসঙ্গে তার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে আলােচনা করে।
পঞ্চমত, রাষ্ট্রবিজ্ঞান শুধুমাত্র ইতিহাস থেকে উপাদান সংগ্রহ করে না। অন্যান্য শাস্ত্র থেকেও উপাদান সংগ্রহ করে। যেমন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলােচনার ক্ষেত্রে অর্থনীতি, সমাজনীতি, পরিসংখ্যান প্রভৃতি বিভিন্ন শাস্ত্রের সাহায্য নিয়ে থাকে।
মূল্যায়ন
প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাস দুটি পৃথক সমাজবিজ্ঞান। তথাপি তাদের মধ্যে সম্পর্ক আছে। লিকক যথার্থই বলেছেন—“Some History is part of Political Science,” অর্থাৎ ইতিহাসের কিছুটা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অংশ। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ফ্রিম্যান (Freeman) মনে করেন—এই দুটি শাস্ত্রের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। তাই তিনি বলেছেন, ইতিহাস হল অতীতের রাষ্ট্রনীতি। আর রাষ্ট্রনীতি হল বর্তমানের ইতিহাস।
প্রশ্ন: সামাজিক সক্রিয়তা হিসাবে রাজনীতির প্রকৃতি আলােচনা করাে।
উত্তর: মানুষ সামাজিক জীব। সমাজের মধ্যে সে পরস্পরের উপর নির্ভরশীল। সমাজবদ্ধ মানুষকে কতকগুলি নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়। সমাজের উন্নত সংগঠন হিসাবে রাষ্ট্রকে এই নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়। রাজনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিশ্লেষণ সমাজজীবন বিশ্লেষণের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সমাজজীবন বিবর্তিত হচ্ছে। বিবর্তিত হচ্ছে রাষ্ট্রজীবনও। পরিবর্তন ঘটছে রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপেরও। মানুষ শুধু সামাজিক জীব নয়, রাজনৈতিক জীবও বটে। তাই স্বাভাবিক কারণেই রাজনীতি, দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা মানুষের জীবনধারাকে প্রভাবিত করছে প্রতিনিয়ত।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মধ্যেই সমাজজীবনের রাজনৈতিক বিচারবিশ্লেষণের সূত্রপাত ঘটে। সমাজে আছে সহযােগিতা, আছে দ্বন্দ্ব। দ্বন্দ্ব-সংঘাত নিয়ন্ত্রণের জন্য আছে নানান বিধিব্যবস্থা যা নিয়ন্ত্রণ করে রাষ্ট্র। রাষ্ট্র একটি শক্তিশালী সংস্থা যার আছে একটি জনসমাজ। এই জনসমাজ রাষ্ট্রীয় নিয়মকানুন মেনে চলে। তা সত্ত্বেও সমাজবদ্ধ মানুষই রাজনীতিতে শেষ কথা বলে। রাষ্ট্র গঠন, সরকারের পরিবর্তন প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে রয়েছে মানুষের সক্রিয়তা’। এককথায় একে বলা হয় রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ।
সমাজে এমন একটা সময় ছিল যখন সমাজের বিভিন্ন প্রথা, রীতিনীতি দ্বারা সমাজ চালিত হত। সমাজে বয়স্ক ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিরাই ছিল এর পরিচালক। কালক্রমে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়। সমাজে নানা জটিলতা দেখা দেয়। সম্পদ উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থার মধ্যে অসংগতি দেখা দেয়। এই ব্যবস্থায় ধীরে ধীরে উদ্ভব হয় রাষ্ট্রব্যবস্থার। সমাজতাত্ত্বিক অন্য দৃষ্টিভঙ্গিতে রাজনীতির ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাদের মতে, রাজনৈতিক আচরণ হল সামাজিক আচরণের বহিঃপ্রকাশ। সমাজজীবন থেকে রাজনীতি পৃথক নয়। সামাজিক সমস্যার প্রতিফলন ঘটে রাজনৈতিক সমস্যার মধ্যে। সমস্ত সামাজিক সম্পর্কের মধ্যেই রাজনীতি আছে। আর রাজনীতির মূলকথাই হল ‘ক্ষমতার ব্যবহার। একটি পরিবারের প্রধান পরিবারের সদস্যদের যে নিয়ন্ত্রণ করেন এর মধ্যেও রাজনীতি থাকে। রাজনীতিবিদদের কার্যকলাপের মধ্যে যেমন রাজনীতি আছে, তেমনি রাজনীতি আছে বিভিন্ন ক্রিয়া- প্রক্রিয়ার মধ্যেও। সমাজে বিভিন্ন বিবাদ-বিসংবাদ, মীমাংসা, সমঝােতা প্রভৃতি সামাজিক আচরণের মধ্যে রাজনীতির অভিব্যক্তি ঘটে। সুতরাং, রাজনীতির পরিধি ব্যাপক। মানুষের প্রায় সমস্ত ক্রিয়াকলাপের মধ্যে আছে রাজনীতির ছোঁয়া। আর রাজনৈতিক সিদ্ধান্তসমূহ হল জনসাধারণ সম্পর্কিত এবং কর্তৃত্বমূলক। রাজনীতির সঙ্গে মানুষ সবসময়ই যুক্ত। মানুষ ও সমাজজীবন নিয়েই রাজনীতির ক্রিয়াকলাপ দেখা যায়। সুতরাং, রাজনীতি অবশ্যই সামাজিক।
পরিশেষে বলা যায় যে, রাজনীতির প্রভাব সর্বব্যাপী। তবে রাজনীতির একটি সংকীর্ণ ধারণাও আছে। এই সংকীর্ণ ধারণা অনুসারে রাজনৈতিক কার্যকলাপ বলতে দলীয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়, সংসদ, মন্ত্রীসভা, নির্বাচন প্রভৃতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কাজকর্মকে বােঝায়। রাজনীতি বলতে বােঝায় মতভেদ ও মতভেদের সঙ্গে যুক্ত রাজনৈতিক কার্যকলাপ। রাজনীতির মৌল উপাদান হল মতভেদ বা বিরােধী এবং এই বিরােধের মীমাংসা। এমনকি নীতি প্রণয়ন, প্রয়ােগ এবং প্রতিরােধের ব্যাপারেও রাজনৈতিক কার্যকলাপ দেখতে পাওয়া যায়। সমাজের জনপ্রতিনিধিরা, সরকারি কর্মচারী, এমনকি বিচারপতিরাও রাজনৈতিক কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত আছেন। নানা কারণে রাজনৈতিক কার্যকলাপের সৃষ্টি হয়। যেমন—বিরােধ ও সংঘর্ষের মধ্যে রাজনৈতিক কার্যকলাপের সৃষ্টি হতে পারে। এক কথায় বলা যায় যে, সমাজনীতি ও রাজনীতি উভয়ের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক গভীর। সামাজিক পটভূমিতেই রাজনীতির বিচারবিশ্লেষণ সম্ভব। রাজনীতির ভিত ছড়িয়ে আছে সমগ্র সমাজের মধ্যে। এটাই রাজনীতির প্রকৃতির মূলকথা। স্যাবাইন (Sabine) যথার্থই বলেছেন—“রাজনৈতিক তত্ত্বের কাজ রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে সুশৃঙ্খলভাবে অনুসন্ধান।”
প্রশ্ন: সমাজ বিবর্তনের রাজনীতির প্রকৃতি বিশ্লেষণ করাে।
উত্তর: মানুষ যখন সমাজ গড়ে তখন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে তার পরিচয়। মানুষ নিজের প্রয়ােজনে রাজনীতি করে। রাজনীতিকে টিকিয়ে রাখে। নৃ-বিজ্ঞানীরা রাষ্ট্রহীন সমাজের কথা বললেও, সমাজ কখনােই রাজনীতিবিহীন ছিল না। গ্রিক ‘পলিটি’-কে ইংরেজিতে ‘স্টেট’ বা রাষ্ট্র বলা হয়। আসলে এর অর্থ রাজনৈতিক সমাজ। মানুষ কতকগুলি আচরণবিধি দ্বারা শাসিত হয়। আমাদের পূর্বপুরুষরাও এভাবে শাসিত হয়েছে। মানুষ ভাবে কোন্টা উচিত? কেন উচিত? এইসব প্রশ্ন খুঁজতে গিয়ে মানুষকে আরও মৌলিক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। যেমন—সমাজজীবনের লক্ষ্য কী? সরকারেরই বা উদ্দেশ্য কী? কীভাবে এর লক্ষ্যপূরণ সম্ভব?
রাজনীতির মূল বিষয়বস্তু হল দ্বন্দ্ব ও পার্থক্য। পারস্পরিক স্বার্থের দ্বন্দ্ব এবং এই দ্বন্দ্ব কীভাবে নিরসন করা যায়। রাজনীতির মূল উপাদান দুটি- ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব। ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির কর্তৃত্বের সম্পর্ক। রাজনীতির প্রশ্নগুলি ছিল মূলত আদর্শ, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। ফলে রাজনীতি আলােচনার প্রকৃতি ছিল ‘স্পেকুলেটিভ’ (Speculative), অর্থাৎ তথ্যনির্ভর নয়, যুক্তিনির্ভর। সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করা হত যুক্তির সাহায্যে। বর্তমানকে বিশ্লেষণ করে নয়। এই আলােচনা ছিল দর্শনধর্মী।
ইউরােপে রাজনীতির তত্ত্ব আলােচনা শুরু হয় গ্রিক দেশে। খ্রিস্টের জন্মের ৫০০-৬০০ বছর পুর্বে। প্রায় সমসাময়িককালে ভারতেও রাজনীতি সম্পর্কে ভাবনা-চিন্তা বিকাশলাভ করে। তবে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সূচনা হয় পঞ্চদশ শতাব্দীতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মেকিয়াভেলির সময় থেকে। মেকিয়াভেলিই প্রথম চিন্তাবিদ যিনি দার্শনিক যুক্তিতর্ক দিয়ে রাজনীতির বর্তমান সমস্যা নিয়ে আলােচনা করেছেন। রাজনীতিকে ধর্ম ও নৈতিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন করেছেন।
সম্পূর্ণ একটি পৃথক শাস্ত্র হিসাবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পঠনপাঠন শুরু হয় উনবিংশ শতাব্দীতে। তবে রাষ্ট্রবিজ্ঞান নামটি তখনও প্রচলিত হয়নি। বলা হত ‘ রাজনীতির বিজ্ঞান (Science of Politics)। ১৮২৯ সালে টি. বি. মেকলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে ‘মহৎ বিজ্ঞান’ (Noble Science) বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি লিখেছেন, “জাতির কল্যাণে নিয়ােজিত ইহা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞান। এই বিজ্ঞানের আলােচনা মানসিকতার সম্প্রসারণ ঘটায় এবং তাকে উজ্জীবিত করে।” এর সত্তর বছর পর হেনরি সিজউইক তাঁর “The Elements of Politics” বই লেখেন। তাতে তিনি রাজনীতির বিজ্ঞানে ব্যবহৃত ধারণাগুলিকে আরও সুসংহত ও সুশৃঙ্খল করার উপর গুরুত্ব দেন।
পরবর্তীকালে প্লেটো, বোদা, মেকিয়াভেলি, হ, লক্, মন্তেস্কু, রুশাে প্রভৃতি দার্শনিকরা রাজনীতি ও সমাজ সম্পর্কে আরও ব্যাপক রাজনৈতিক তত্ত্ব নির্মাণ করেন। স্যাবাইন-এর ভাষায়, গােষ্ঠীজীবন ও সংগঠনের সমস্যাগুলিকে সচেতনভাবে অনুধাবন ও সমাধানের চেষ্টা হল রাজনীতি। কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীতে সামাজিক অবস্থা ও পরিবেশের পরিবর্তন ঘটে। মানুষের জৈব, প্রাকৃতিক ও সমাজ পরিবেশ সম্পর্কে জ্ঞানের প্রকাশ ঘটে।
অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডে ‘অভিজ্ঞতাবাদ’ এবং ফ্রান্সে ‘দৃষ্টবাদের প্রভাবে সমাজবিজ্ঞানের আলােচনাতেও প্রকৃতি বিজ্ঞানের পদ্ধতির ব্যবহার গুরুত্ব পেতে শুরু করল। এই সময়ে রাজনীতির আলােচনাকেও অভিজ্ঞতাভিত্তিক করার চেষ্টা হয়। তবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ইতিহাস পাঠে জানা যায় যে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের সঙ্গে তুলনীয় একটি বিজ্ঞানে উন্নীত করার প্রবণতা দেখা যায় আরও পরে। বর্তমান শতাব্দীর তৃতীয় দশক থেকে, প্রধানত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। এই শতাব্দীর তৃতীয় দশকে অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আচরণবাদী নামে এক ধরনের রাষ্ট্র বিজ্ঞানীদের আবির্ভাব ঘটল। একটানা চার দশক আমেরিকাতে রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলােচনায় মুখ্য ভূমিকা নেয় আচরণবাদ।
গত কয়েক দশকে পশ্চিমের ‘Academic Political Science’-এর পাশাপাশি রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চার আর একটি ধারা প্রভাব বিস্তার করে। তা হল মার্কসীয় ধারা। বৈজ্ঞানিক ধারা বা পদ্ধতি। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজীয় পাঠক্রমে মার্কসীয় তত্ত্ব পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। উনবিংশ শতাব্দীতে যে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জন্ম হয়েছিল তার শেকড় ছিল ধনতান্ত্রিক সমাজে। ধনতান্ত্রিক সমাজের রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং রাজনীতির পরিকাঠামাে ব্যাখ্যা করাই ছিল এই বিজ্ঞানের লক্ষ্য। এই আলােচনা ছিল ব্যক্তিকেন্দ্রিক। যাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে উদারনীতিবাদ বা Liberalism। রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চার এই ধারাটিকে বলে “লিবারাল ট্র্যাডিশন” অপরদিকে, মার্কসীয় ধারাটিকে বলা হয় ‘মার্কসিস্ট ট্র্যাডিশন’। রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলােচনার জন্য এই দুটি ট্র্যাডিশনই সমান গুরুত্বপূর্ণ।
প্রশ্ন: উদারনীতিবাদ বলতে কী বােঝায় ? ইহার মুল নীতিগুলি ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: উদারনীতিবাদ বর্তমানে একটি জনপ্রিয় মতবাদ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। ল্যাস্কি (Laski) বলেছেন, ইউরােপের ধর্মসংস্কার আন্দোলন উদারনীতিবাদের জন্মলা। বিশ শতকের প্রথমদিকে এর গুরুত্ব কমে গেলেও বর্তমানে মার্কসবাদের বিরুদ্ধে একটা বড়ো চ্যালেঞ্জ হিসাবে এটি জেগে উঠেছে।
উদারনীতিবাদের সংজ্ঞা (Definition)
উদারনীতিবাদ বা Liberalism শব্দটি ল্যাটিন শব্দ Liber থেকে এসেছে। Liber কথাটির অর্থ। হল স্বাধীন। সুতরাং উদারনীতিবাদের অর্থ হল—ব্যক্তিস্বাধীনতার মতবাদ। অর্থাৎ যে মতবাদ ব্যক্তির স্বাধীন চিন্তা ও স্বাধীন মতপ্রকাশের উপর গুরুত্ব আরােপ করে, স্বাধীনতার অধিকার ও ব্যক্তিগত সম্পত্তি প্রভৃতিকে ব্যক্তিত্ব বিকাশের প্রধান উপায় বলে মনে করে, তাকে বলে উদারনীতিবাদ। এই মতবাদ, রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে একদিকে যেমন প্রতিবাদে সোচ্চার, অন্যদিকে তেমনি মানুষের | স্বাধীনতার জয়গানে মুখর।
উদারনীতিবাদের মূলনীতি
প্রাচীনকালে গ্রিক দার্শনিকেরা ব্যক্তিস্বাধীনতার পক্ষে মত প্রচার করে উদারনীতিবাদের গােড়াপত্তন করেছেন। উদারনীতিবাদকে দু-ভাগে ভাগ করা যায়। একটি সনাতনী উদারনীতিবাদ ও অপরটি আধুনিক উদারনীতিবাদ। এই উভয়ের সমন্বয়ে উদারনীতিবাদের নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্য বা নীতিগুলি দেখতে পাওয়া যায়-
(ক) ব্যক্তিস্বাধীনতা
উদারনীতিবাদ ব্যক্তির স্বাধীনতার উপর সবথেকে বেশি গুরুত্ব আরােপ করে। তারা স্বাধীনতার উপর কোনাে নিয়ন্ত্রণের পক্ষপাতি নয়। কারণ, তারা মনে করে নিয়ন্ত্রণ থাকলে ব্যক্তির বিকাশ হবে না।
(খ) ব্যক্তিগত সম্পত্তি
উদারনীতিবাদ নাগরিকদের ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার স্বীকার করে। কারণ, এতে ব্যক্তি কাজকর্মে উৎসাহ পায়। ফলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটে।
(গ) রাজনৈতিক সাম্য
উদারনীতিবাদ রাজনৈতিক সাম্যনীতিতে বিশ্বাসী। অর্থাৎ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সকলে সমান অধিকার পাবে। এই সাম্যনীতির প্রেক্ষাপটে সরকারের লক্ষ্য হবে সব মানুষের কল্যাণ সাধন করা। (ঘ) নিরপেক্ষ আদালত উদারনীতিবাদ ন্যায় বিচারের জন্য একটি নিরপেক্ষ আদালতের পক্ষপাতী। এই আদালত একদিকে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার রক্ষা করে। অন্যদিকে সংবিধানের ব্যাখ্যা করে।
(ঙ) বহুদলীয় ব্যবস্থা
উদারনীতিবাদীরা গণতন্ত্রে একাধিক দল রাখার পক্ষপাতী। একাধিক দল থাকলে জনগণ স্বাধীনভাবে প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারবে। এখানে বিরােধী দল থাকে বলে তারা সরকারের সমালােচনা করে। ফলে সরকার স্বৈরাচারী হতে পারে না।
(চ) অর্থনৈতিক স্বাধীনতা
উদারনীতিবাদীরা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সকলের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। তারা অবাধ বাণিজ্য সমর্থন করে। তারা অর্থনৈতিক কাজকর্মের উপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের বিরােধী। তারা মনে করে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অবাধ নীতি থাকলে প্রতিযােগিতা থাকবে। তাতে উৎপাদনের মান বাড়বে এবং দাম কমবে।
(ছ) শান্তিপূর্ণ উপায়ে পরিবর্তন
উদারনীতিবাদ বিপ্লবের পথে সমাজের পরিবর্তন চায় না। তারা শান্তিপূর্ণ উপায়ে বুলেটের পরিবর্তে ব্যালটের মাধ্যমে সমাজের পরিবর্তনে বিশ্বাসী।
(জ) ধর্মনিরপেক্ষতা
উদারনীতিবাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি হল—ধর্মনিরপেক্ষতা ও সহনশীলতা। ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ হল প্রত্যেকে তার বিশ্বাস অনুযায়ী ধর্ম পালন করবে। রাষ্ট্র কোনাে বিশেষ ধর্মের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করবে না। কোনাে ধর্মকে জোর করে চাপিয়ে দেবে না। ধর্মের ব্যাপারে রাষ্ট্র নিরপেক্ষ থাকবে। ধর্মনিরপেক্ষতা মানুষকে অন্য ধর্মের প্রতি সহনশীল করে তােলে।
(ঝ) সার্বিক ভােটাধিকার
উদারনীতিবাদে সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভােটাধিকারের নীতি স্বীকৃত হয়। জাতি, ধর্ম, নারী-পুরুষ, ধনী- দরিদ্র নির্বিশেষে সবাই এখানে স্বাধীনভাবে ভােট দিতে পারে।
(ঞ) গণমাধ্যমের স্বাধীনতা
উদারনীতিবাদ সংবাদপত্র, বেতার, দূরদর্শন প্রভৃতি গণসংযােগের মাধ্যমগুলির স্বাধীনতা স্বীকার করে। এই স্বাধীনতার ফলে তারা সরকারের কাজকে সমালােচনা করতে পারে। তাতে সরকার সংযত হয়ে চলতে চেষ্টা করবে।
সমালােচনা
এই মতবাদ সমালােচনামুক্ত নয়। মার্কসবাদীরা উদারনীতিবাদকে বিভিন্ন দিক দিয়ে সমালােচনা করেছেন-
প্রথমত, উদারনীতিবাদ রাজনৈতিক সাম্যের কথা বললেও অর্থনৈতিক সাম্যের কথা বলেনি।
দ্বিতীয়ত, এখানে যারা বিত্তশালী তারাই জনমত গঠনের মাধ্যমগুলি নিয়ন্ত্রণ করে। তাই এখানে প্রকৃত জনমত গড়ে উঠতে পারে না।
তৃতীয়ত, এখানে বিচারকেরা উচ্চবিত্ত শ্রেণি থেকে আসে। তাদের কাছ থেকে সাধারণ মানুষের জন্য ন্যায়বিচার আশা করা যায় না।
চতুর্থত, উদারনীতিবাদীরা রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে সীমিত করতে চায়। অথচ ব্যক্তির বিকাশের জন্য যে পরিবেশ দরকার, রাষ্ট্র তা সৃষ্টি করে।
পঞ্চমত, উদারনীতিবাদীরা ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার স্বীকার করে। কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পত্তি সমাজে বৈষম্য সৃষ্টি করে। তাতে সাধারণ মানুষ সাম্য ও স্বাধীনতার স্বাদ থেকে বঞ্চিত হয়।
মূল্যায়ন
সমালােচিত হলেও উদারনীতিবাদ ব্যক্তিস্বাধীনতার পক্ষে মত প্রচার করে মানুষের করতে স্বাগত জানিয়ে জাতীয় সম্পদ বৃদ্ধির পথ সুগম করেছে। বিশেষ করে বর্তমানে মার্কসবাদী সমাজতন্ত্রে যেভাবে ব্যক্তিস্বাধীনতার কণ্ঠরােধ করা হয়েছে, তার হাত থেকে মুক্তি পাবার জন্য উদারনীতিবাদের গুরুত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে।
প্রশ্ন: মার্কসবাদ কাকে বলে? মার্কসবাদের মূলনীতিগুলি বর্ণনা করাে।
উত্তর: কার্ল মার্কস হলেন বৈজ্ঞানিক সমাজবাদের জনক। তিনি ইতিহাসের বস্তুবাদী দৃষ্টিতে সমাজের পরিবর্তনের মূল সূত্র বের করে তার আলােকে সাম্যবাদী সমাজ গড়ে তােলার বিজ্ঞানসম্মত পথ দেখিয়েছেন। রাষ্ট্র ও সমাজ সম্পর্কে তাঁর দার্শনিক চিন্তাভাবনাকে বলা হয় মার্কসবাদ। লেনিনের ভাষায়, “মার্কসের দৃষ্টিভঙ্গি ও শিক্ষার নামই হল মার্কসবাদ।” মার্কস ও এঙ্গেলস মানবসমাজের উৎপত্তি ও বিকাশ সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন—সমাজের পরিবর্তন নির্দিষ্ট নিয়মে হয়। এই নিয়ম অনুসারে বিপ্লবের মাধ্যমে সর্বহারা শ্রেণি পুঁজিবাদের অবসান ঘটাবে এবং শােষণমুক্ত সমাজ গড়ে তুলবে। সেদিক থেকে বলা যায়—মার্কসবাদ হল একটি বৈপ্লবিক মতবাদ যা সর্বহারা শ্রেণিকে বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষিত করে এবং শ্রেণিহীন সাম্যবাদী সমাজ গড়ে তুলতে একটি মতাদর্শ হিসাবে কাজ করে। এই মার্কসীয় দর্শন নিম্নলিখিত মূল নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত :
(ক) দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ
হেগেলের দ্বন্দ্ববাদ থেকে মার্কস-এর দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ গড়ে উঠেছে। মার্কস-এর মতে আমরা যে জগৎকে দেখি তা একান্তভাবে বস্তুজগৎ। বস্তুই আসল। মানুষের চেতনা, অনুভূতি এবং কল্পনা বস্তুকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। বস্তুর পরিবর্তন ঘটে। সেই পরিবর্তন বাইরের কোনাে শক্তির দ্বারা ঘটে না। বস্তুর মধ্যে অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব থাকে। এই দ্বন্দ্ব বস্তুর পরিবর্তন ঘটায়। এই ধারণা থেকে গড়ে উঠেছে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ।
(খ) ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যা
মার্কস তাঁর দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের ইতিহাসের প্রেক্ষাপট প্রয়ােগ করে যে তত্ত্ব গড়ে তুলেছেন তাকে বলে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ। তাঁর মতে সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামাের উপর ইতিহাসের ঘটনা গড়ে ওঠে। অর্থনৈতিক কাঠামাে বলতে সমাজের উৎপাদন পদ্ধতি বােঝায়। উৎপাদন পদ্ধতির দুটি দিক আছে—(i) উৎপাদিকা শক্তি ও (ii) উৎপাদন সম্পর্ক। উৎপাদিকা শক্তি বলতে শ্রমিক ও শ্রমের ক্ষমতাকে বােঝায়। উৎপাদন সম্পর্ক বলতে বােঝায়—উৎপাদন ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা মানুষে মানুষে তথা শ্রেণিতে শ্রেণিতে যে সম্পর্ক। মার্কস মনে করেন—উৎপাদিকা শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে সমন্বয় থাকলে, শােষণহীন উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে উঠবে।
(গ) উদ্বৃত্ত মূল্য
মার্কস-এর মতে পুঁজিবাদী সমাজে শােষণের চূড়ান্ত রূপ হল—মালিকশ্রেণি কর্তৃক উদ্বৃত্ত মূল্যের (Surplus Value) আত্মসাৎ করা। শ্রমিক তার শ্রম দিয়ে যতটুকু মূল্য সৃষ্টি করে—তা বাজারে বিক্রি করে মালিকশ্রেণি যে অর্থ পায় এবং শ্রমিককে যতটুকু মজুরী দেয় তার পার্থক্যকে বলে উত্ত মূল্য। এটি শ্রমিকের প্রাপ্য। কিন্তু তা থেকে তারা বঞ্চিত হয়।
(ঘ) শ্রেণিসংগ্রামের তত্ত্ব
মার্কস বলেছেন—আজ পর্যন্ত মানব সমাজের ইতিহাস হল শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস। দাস সমাজে ব্যক্তিগত মালিকানা আসে। এক শ্রেণি অন্য শ্রেণিকে শােষণ করতে শুরু করে। ফলে দেখা দেয় শ্রেণিতে শ্রেণিতে সংগ্রাম। পরবর্তীকালে সামন্ত সমাজে সামন্ত প্রভু ও ভূমিদাস এবং পুঁজিবাদী সমাজে বুর্জোয়া ও সর্বহারা শ্রেণিতে সমাজ বিভক্ত হয়ে পড়ে। এদের মধ্যে সংগ্রাম তীব্রতর হয়।
(ঙ) বিপ্লব তত্ত্ব
মার্কসের মতে বিপ্লবের কারণ হল-উৎপাদনের উপাদানের সঙ্গে উৎপাদন সম্পর্কের বিরােধ। প্রাচীন সমাজে এই বিরােধ ছিল না। কারণ যে মালিক, সেই ছিল শ্রমিক। তাই শ্রমিকে মালিকে দ্বন্দ্ব ছিল না। কিন্তু উৎপাদন ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় উৎপাদন শক্তির মালিকানা মুষ্টিমেয় কয়েকজনের হাতে চলে যায়। ফলে মালিকশ্রেণির সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে গড়ে ওঠে সর্বহারা শ্রমিকশ্রেণি। এই সময়ে শােষণ শুরু হল। শােষণ থেকে অসন্তোষ। তার ফলশ্রুতি হল বিপ্লব। বিপ্লবের উদ্দেশ্য হল–সর্বহারা শ্রেণির নেতৃত্বে রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখল করে প্রতিক্রিয়াশীলদের হাত থেকে উৎপাদনের উপকরণগুলি ছিনিয়ে নিয়ে তাদের নির্মূল করে দেওয়া এবং শ্রেণিহীন সমাজ গড়ে তােলা।
(চ) রাষ্ট্র সম্পর্কে তত্ত্ব
মার্কস বলেছেন, রাষ্ট্র একটি শােষণের যন্ত্র। আদিম সাম্যবাদী সমাজে ব্যক্তিগত মালিকানা ছিল না। দাস সমাজ ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত মালিকানা সৃষ্টি হয়। এই সময় থেকে শােষণ শুরু হয়। রাষ্ট্র শােষণের যন্ত্র হিসাবে গড়ে ওঠে। পুঁজিবাদী সমাজে শােষণ তীব্র আকার ধারণ করে। যার ফলশ্রুতি হল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। বিপ্লবের পর সর্বহারা শ্রেণি রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখল করে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে নির্মূল করবে। সমাজ থেকে শােষণের অবসান ঘটবে। শােষণ যখন থাকবে না, তখন রাষ্ট্রের প্রয়ােজন ফুরিয়ে যাবে। রাষ্ট্রের অবলুপ্তি ঘটবে। গড়ে উঠবে শ্রেণিহীন, শােষণহীন, সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা। যার মূলনীতি হল, প্রত্যেকে তার সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করবে এবং প্রয়ােজনমত ভােগ করবে।
সমালােচনা
মার্কসবাদী তত্ত্ব সমালােচনা মুক্ত নয়। বিভিন্নভাবে এই নীতি ও তত্ত্ব সমালােচিত হয়েছে –
প্রথমত, মার্কস অর্থনৈতিক বিষয়ের উপর অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়েছেন। অর্থনীতি ছাড়া মানুষের জীবনে প্রেম-প্রীতি, স্নেহ-মমতা বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে।
দ্বিতীয়ত, মার্কস বলেছেন—অর্থনীতি ইতিহাসের ঘটনাকে প্রভাবিত করে। কিন্তু ক্ষমতার প্রতি লােভ, মহাপুরুষের আবির্ভাব, ধর্ম ইতিহাসকে অনেক সময় প্রভাবিত করে।
তৃতীয়ত, মার্কস বলেছেন—শিল্পোন্নত দেশে শ্রমিকরা চরমভাবে শােষিত হবে। তাই সেখানে বিপ্লব অবশ্যই দেখা দেবে। কিন্তু সে কথা সত্য হয়নি।
চতুর্থত, মার্কস রাষ্ট্রকে শ্রেণি শােষণের যন্ত্র বলেছেন। বর্তমানে রাষ্ট্র কল্যাণকর রাষ্ট্র বলে বিবেচিত হচ্ছে। তাই রাষ্ট্রের অবলুপ্ত হবার সম্ভাবনা নেই।
মূল্যায়ন
মার্ক্সবাদী তত্ত্ব ও মূলনীতির বিরুদ্ধে সমালোচনার যুক্তিগুলিকে একেবারে অস্বীকার করা যাবে না। বিশেষ করে সমাজতন্ত্রী দেশগুলিতে মার্কসবাদের বিপর্যয়ের ফলে এটি এখন অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছে। তথাপি মার্কসবাদী তত্ত্বের অবদানকে অস্বীকার করা যায় । অধ্যাপক ল্যাস্কি (Laski) যথাযথই বলেছেনm “শ্রমজীবী মানুষ যখন নিজেদের অবস্থার উন্নতি ঘটাতে আন্দোলন করেছে, তখন এই তত্ত্ব তাদের প্রেরণা দিয়েছে।”
প্রশ্ন: রাজনীতির সঙ্গে সামাজিক কার্যাবলির (social Activity) সম্পর্ক ব্যাখ্যা করাে।
উত্তর: রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল রাষ্ট্র সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান। যে শাস্ত্র পাঠ করলে রাষ্ট্র সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান পাওয়া যায় তাকে বলা হয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান। অর্থাৎ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মূল আলােচ্য বিষয়বস্তু হল রাষ্ট্র। অধ্যাপক গেটেলের ভাষায়- “Political Science is the Study of the State.”
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা সামাজিক বিষয় নিয়ে আলােচনার সূত্রপাত ঘটান। প্রকৃতপক্ষে, আধুনিককালের রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রাজনীতির আলোচনার ক্ষেত্রে সামাজিক ভিত্তির উপর গুরুত্ব আরােপ করতে চান। কারণ রাজনৈতিক কার্যকলাপে সমাজের মানুষেরাই অংশগ্রহণ করে। সমাজকে বাদ দিয়ে রাজনীতি হতে পারে না। তাই রাজনীতির ভিত্তি হল—সমাজ ও সামাজিক কার্যকলাপ। তাই সামাজিক জীবনকে বাদ দিয়ে কোনো রাজনৈতিক তত্ত্ব গড়ে উঠলে তা অবাস্তব হবে। কোন্ রাজনৈতিক তত্ত্ব কীভাবে জন্ম নিয়েছে তা জানতে গেলে সামাজিক পরিস্থিতি জানা দরকার। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় হবসের সামাজিক চুক্তি মতবাদের গুরুত্ব জানতে গেলে সে সময়কার সামাজিক পরিস্থিতি জানতে হবে। রাজনীতির এই সামাজিক ভিত্তি ব্যাখ্যা করতে গেলে প্রথমে রাজনীতি বলতে কী বােঝায়, তা সংক্ষেপে বলা প্রয়ােজন।
রাজনীতির সংজ্ঞা
সংকীর্ণ অর্থে রাজনীতি বলতে বােঝায় রাজনীতিবিদদের আচরণ ও কার্যকলাপ। কিন্তু প্রকৃত অর্থে রাজনীতি বলতে শুধুমাত্র রাজনৈতিক নেতাদের কৌশল ও কার্যাবলি নয়। সমাজের বৃহত্তর কার্যাবলি | এর সঙ্গে যুক্ত। সমাজের মধ্যে বিরােধের যেমন সম্ভাবনা থাকে, তেমনি সেই বিরােধের মীমাংসার সূত্র থাকে। রাজনীতি হল সেই সামাজিক বিরােধ ও মীমাংসা সম্পর্কিত কার্যাবলি। এই বিরােধ ও মীমাংসার ক্ষেত্রে ক্ষমতা প্রয়ােগের প্রশ্ন আসে। তাই অধ্যাপক ডাল (Dahl) বলেছেন—রাজনীতি বলতে ক্ষমতার ব্যবহার বােঝায়।
রাজনীতির সামাজিক ভিত্তির প্রকৃতি
রাজনীতিক সমাজতাত্ত্বিকেরা মনে করেন, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভিত্তির উপর রাজনৈতিক কার্যকলাপ গড়ে ওঠে। তাই রাজনৈতিক আচরণ ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের আলােচনা সামাজিক ভিত্তির উপর গড়ে তােলা উচিত। মার্কিন রাজনীতিক সমাজবিজ্ঞানী লিপসেট (Lipset) এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলােচনা করেছেন। তাঁর মতে সমাজে বিভিন্ন শ্রেণি, গােষ্ঠী, দল প্রভৃতি থাকে। নির্বাচনী আচার-আচরণ এইসব সামাজিক উপাদানের উপর নির্ভর করে। সামাজিক প্রেক্ষাপটকে বাদ দিয়ে রাজনৈতিক সমস্যার বিচার করা সম্ভব নয়। সামাজিক দিক উপেক্ষা করে রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে এগিয়ে গেলে তা ব্যর্থ হতে বাধ্য। রাজনৈতিক সমস্যার মূলে পৌঁছাতে গেলে সামাজিক পটভূমিকে জানতে হবে। রাজনীতির সঙ্গে সমাজের এই সম্পর্ক দুটি ভাগে আলােচনা করা যায়–
(ক) রাজনীতির উপর সমাজের প্রভাব
সমাজব্যবস্থার উপর রাজনৈতিক কাঠামাে গড়ে ওঠে। সামাজিক পরিবেশের মধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান কাজ করে। যেমন, রাজনৈতিক দলের কাজকর্ম শুধু রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে আবদ্ধ থাকে না, সারা সমাজে ছড়িয়ে থাকে। সমাজের বিভিন্ন শক্তি নির্বাচনকে প্রভাবিত করে। যেমন, রামমন্দির নির্মাণ নির্বাচনকে প্রভাবিত করেছে। প্লেটোর রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা সামাজিক চিন্তাভাবনার পটভূমিতে গড়ে উঠেছে। তাই রাজনীতির উপর সমাজের প্রভাবকে অস্বীকার করা যাবে না।
(খ) সমাজনীতির উপর রাজনীতির প্রভাব
রাজনীতি আবার সমাজনীতিকে প্রভাবিত করে। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলি এবং সরকারি সিদ্ধান্ত সামাজিক কাজকর্মকে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত করে। রাষ্ট্রীয় আইন সামাজিক কুসংস্কারকে দূর করতে সাহায্য করে। যেমন, রাষ্ট্রীয় আইনের মাধ্যমে সতীদাহপ্রথা দুরীভূত হয়েছে। আবার রাজনৈতিক নেতৃত্ব অনেক সময় সমাজের মানুষের মূল্যবােধ ও মানসিকতাকে প্রভাবিত করে।
মূল্যায়ন
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, সমাজকে এবং সামাজিক কাজকর্মের আলােচনাকে বাদ দিয়ে রাজনীতির আলােচনা সম্পূর্ণ হতে পারে না। সমাজে অন্যের প্রভাব বিস্তারকারী শক্তি আছে। যেমন, ধর্ম, জাতপাত, ভাষা প্রভৃতি। এগুলি রাজনীতিকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। ভারতের রাজনীতির দিকে তাকালে এর সত্যতা প্রমাণিত হবে। তাই রাজনীতির আলােচনায় সামাজিক প্রেক্ষাপটকে অস্বীকার করা যাবে না।
প্রশ্ন: রাষ্ট্রনীতি আলােচনায় উদারনৈতিক ও মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে পার্থক্য দেখাও।
উত্তর: রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল সমাজবিজ্ঞানের একটি শাখা। তাই সমাজের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সমাজবিজ্ঞানের এবং সেইসঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচনার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন ঘটে। ফলে পুরাতন অনুসন্ধান পদ্ধতি বা দৃষ্টিভঙ্গির পাশাপাশি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে। পুরাতন বা সনাতনী দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি। নতুন দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি। এই দুটি দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে মৌলিক পার্থক্য আছে। সেগুলি নিম্নে আলােচিত হল-
(ক) রাষ্ট্রনীতির সংজ্ঞা নির্ধারণের ক্ষেত্রে
রাষ্ট্রনীতির সংজ্ঞা বা চরিত্র নির্ধারণের ক্ষেত্রে উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গির মৌলিক পার্থক্য আছে। উদারনীতিবাদীরা বলেন—রাষ্ট্রনীতি হল সরকার, রাজনৈতিক দল এবং ব্যক্তি ও গােষ্ঠীর রাজনৈতিক কার্যকলাপের সমষ্টি। সমাজে বিভিন্ন মতের মধ্যে বিরােধ দেখা দেয়। সেই বিরােধের মীমাংসা করার চেষ্টা করা হয়। তা না হলে সমাজব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। এই বিরােধ ও মীমাংসার প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রনীতি জন্ম নেয়। কিন্তু মার্কসবাদীরা বলেছেন—সমাজে বিভিন্ন শ্রেণি থাকে। প্রত্যেক শ্রেণি নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে। এই মানসিকতা থেকে জন্ম নেয় রাষ্ট্রনীতি। যেমন, পুঁজিবাদী সমাজে বুর্জোয়া ও সর্বহারার মধ্যে বিরােধ দেখা দেয়। এই শ্রেণিগত সংঘর্ষ থেকে রাষ্ট্রনীতি জন্ম নেয়।
(খ) রাষ্ট্রের চরিত্র বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে
রাষ্ট্রের চরিত্র বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে উভয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে। উদারনীতিবাদীরা রাষ্ট্রের প্রয়ােজনীয়তার কথা বলেছেন। উদারনীতিবাদের বিশিষ্ট সমর্থক মিল (Mill) বলেছেন—সমাজের বৃহত্তর কল্যাণের জন্যে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ প্রয়ােজন। কিন্তু মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী। তাদের মতে রাষ্ট্র কল্যাণকামী প্রতিষ্ঠান নয়। রাষ্ট্র হল একটি শােষণের যন্ত্র। এই যন্ত্র দিয়ে এক শ্রেণি অন্য শ্রেণিকে শােষণ করে। আদিম সমাজে শ্রেণি শােষণ ছিল না। তাই রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়নি। সমাজে শ্রেণিশােষণ শুরু হলে রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে। আবার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে শােষকশ্রেণি নির্মূল হলে শােষণ বন্ধ হবে। তখন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব থাকবে না।
(গ) রাজনীতির সঙ্গে অর্থনীতির সম্পর্কের ক্ষেত্রে
উদারনীতিবাদীরা রাজনীতিকে অর্থনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে আলােচনা করার পক্ষপাতী। কারণ তারা মনে করে রাজনীতির ক্ষেত্র ও অর্থনীতির ক্ষেত্র এক নয়। তাই রাজনীতির আলােচনায় অর্থনীতি প্রসঙ্গ আনা ঠিক নয়। কিন্তু মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি হল—রাজনীতিকে অর্থনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব নয়। সমাজে সবকিছু পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। তার মধ্যে কোনাে একটিকে বিচ্ছিন্ন করলে তা অসম্পূর্ণ হবে। তাই রাজনীতি আলােচনা করার সময় সমাজের অন্যান্য দিক ভাবতে হবে। রাজনীতি থেকে সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামাের আলােচনা বাদ দিলে রাজনীতির চরিত্র জানা যাবে না।
(ঘ) সমাজ পরিবর্তনের বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে
উদারনীতিবাদীরা সমাজ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে অর্থনীতির উপর গুরুত্ব দিতে রাজী নয়। ভাববাদীরা বলেছেন- সমাজের পরিবর্তনের মূলে আছে Idea বা ভাব। এখানে বস্তুগত শক্তির ভূমিকা নেই। আছে অলৌকিক শক্তির ভূমিকা। কিন্তু মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ঐতিহাসিক বস্তুবাদের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এর মূল কথা হল বস্তুকে কেন্দ্র করে সমাজের পরিবর্তন ঘটেছে। শুধু তাই নয়, বস্তু বা সমাজের উৎপাদন পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে—সমাজের উপরিকাঠামাে গড়ে ওঠে। রাষ্ট্রের আইন, আদালত, ধর্ম, দর্শন, রাজনীতি প্রভৃতি হল সমাজের উপরি কাঠামাে। এই কাঠামাে অর্থনৈতিক ভিত্তির উপর গড়ে ওঠে।
(ঙ) বিপ্লবের অপরিহার্যতার ক্ষেত্রে
উদারনীতিবাদীরা মনে করেন- সুস্থ সমাজব্যবস্থা গড়ে তােলার ক্ষেত্রে হিংসাত্মক বিপ্লবের কোনাে প্রয়ােজন নেই। কার্ল পপার (Karl Popper) বলেছেন, অর্থনৈতিক পরিকল্পনা, শক্তিশালী শ্রমিক সংগঠন, স্বাধীন বিচারবিভাগ প্রভৃতির মাধ্যমে সুষ্ঠু সমাজ গড়ে তােলা যায়। কিন্তু মার্কসবাদীরা মনে করেন—সমাজের পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব অপরিহার্য। কারণ মার্কসের ভাষায়—বিপ্লব হল ইতিহাসের চালিকাশক্তি। সেই কারণে মার্কসীয় রাষ্ট্রনীতির আলােচনায় বিপ্লব তত্ত্ব বিশেষ স্থান নিয়েছে।
মুল্যায়ন
সুতরাং দেখা যাচ্ছে রাষ্ট্রনীতি পাঠের ক্ষেত্রে উদারনীতিবাদী ও মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে মৌলিক পার্থক্য আছে। এই পার্থক্যের মূল কারণ হল, মার্কসবাদী ঐতিহাসিক বস্তুবাদের আলােকে রাষ্ট্রনীতি আলােচনা ও বিশ্লেষণ করতে চায়। কিন্তু উদারনীতিবাদীরা নিছক বস্তুবাদের আলােকে রাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষণের পক্ষপাতী নন। কারণ তারা মনে করেন, নিছক বস্তু বা অর্থনীতি ছাড়া ধর্ম, ক্ষমতার প্রতি লােভ প্রভৃতি রাজনীতিকে প্রভাবিত করে।
Download সংজ্ঞা, প্রকৃতি, বিষয়বস্তু এবং সামাজিক সক্রিয়তা হিসাবে রাজনীতি PDF
File Details:-
File Format:-PDF
Quality:- High
File Size:- 5 Mb
File Location:- Google Drive
Click Here to Download
আরও পড়ুন:
Others Important Link
Syllabus Link: Click Here
Questions Paper Link: Click Here
Admit Card Link: Click Here
Result Link: Click Here
Latest Job: Click Here
Age Calculator: Click Here
ঘোষণা: বিনামূল্যে আমাদের দেওয়া নোটস, সাজেশান, প্রশ্ন উত্তর ইত্যাদি স্টাডি ম্যাটেরিয়াল PDF এবং ভিডিও ক্লাস ভালো লাগলে, আমাদের এই পোস্টের লিংক আপনার বন্ধুদের ফেসবুক, WhatsApp এ শেয়ার করে তাদের পড়ার সুযোগ করে দিন।
Please do not share any spam link in the comment box